পর্ব ::৮৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
ধর্ম নিরপেক্ষতার আরো একটি মানে ‘ইহজাগতিকতা’, কিন্তু ইহজাগতিকতার পরিধি সীমিত থেকেছে রাজনীতিতে ধর্মকে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শের মধ্যে এবং এটি এসেছে কেবল পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্যের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অনেক সময় ধর্মকে যুক্তির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধর্ম-নির্বিশেষে সমতার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাহাত্তরের সংবিধান। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি অর্থ হচ্ছেু সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বা নন-ডিসক্রিমিনেশন প্রিন্সিপাল। সব মিলিয়ে আমরা পাচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতার তিনটি দিক: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করার ইহজাগতিক বোধ; এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকার। এই তিনটি দিক মেলালে আমরা আমাদের দেশের মতো করে সেক্যুলারিজমের একটি আদল খুঁজে পাই। এরই প্রতিফলন হয়েছে সংবিধানের ১২ নং ধারায়:
‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারাটিকে এর আগের ১১ নং ধারার অধীনে দেখতে হবে, যেখানে রয়েছে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তার’, এবং ‘মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ নিশ্চিত করার কথা।
সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত না করা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে (এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও) সমান অধিকার- ধর্মনিরপেক্ষতার এই তিনটি দিক রক্ষার জন্য নাস্তিক হওয়ারও দরকার নেই। ধর্মহীন বা ধর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা নেই। একজন প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসে অনড় থেকেও এই তিনটি দিকই রাষ্ট্রের কাছে মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করতে পারেন। আমাদের মা-নানীরা ধর্মবিশ্বাসী হয়েও আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সকল ধর্মের মানুষের যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা স্বীকার করে গেছেন। যারা রাজনীতিতে নেমে কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষকে অধিকারহীন করতে চায়, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধাতে চায়, তাদের প্রতি আমাদের পিতৃপুরুষেরা সশঙ্কিত মনোভাব প্রকাশ করতেন এবং তাদের সংস্পর্শ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করতেন। সেকালে অনেক স্থানে যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পাশাপাশি বাস করতেন, তাদের অনেকেরই মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সাথে সাথে এক ধরনের ‘মিশ্র’ সামাজিক-ধর্মীয় আচার গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে বলি, আমি যে-আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, তাতে করে পাড়ায় মিলাদ হলে বা শবেবরাতের সময়, ঈদের পরবে নিত্যই দাওয়াত মিলত প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারদের থেকে। তাদের কাউকে ডাকতাম খালাম্মা, কাউকে পিসিমা বলে, তারা আবার আমার মা-বাবাকে ডাকতেন মাসিমা-মামাবাবু বলে। বাবার এমনি একজন বোন ছিলেন। যাদের সাথে পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই সুদূর ১৯৪৩ সাল থেকে। এই ধর্মবোন-ধর্মভাই শুধু স্বধর্মের অনাত্মীয় লোকদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল না; ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যেই দেখা যেত। আমাদের জীবন-চর্চা ছিল আত্যন্তিকভাবেই ধর্মাশ্রিত এবং তা কখনও কখনও নিজ ধর্ম ছাপিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসকেও স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পেত। গভীর ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি এক ধরনের মিশ্র-আচার বা ‘সংকট’ মনোবৃত্তি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেই ছিল। এটা শুধু তথাকথিত ‘নীচু’ জাতের মানুষদের মধ্যেই ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র’ জাতের মানুষদের মধ্যেও ছিল। আমার মা প্রতিটি পারিবারিক সংকটে-উৎসবে মিরপুরের ‘ঠান্ডা পীরের’ মাজারে বা হাইকোর্টের ‘গরম পীরের’ মাজারে মানত রাখতেন এবং ছোটবেলা থেকেই এই দুই জায়গায় যাওয়া আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে মা তার প্রতি-মঙ্গলবারের মঙ্গলচণ্ডী পূজার সাথে পীর-মাজার সংস্কৃতিকে মেলাতেন তা একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তিনি কোনো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিলেন না। এর বড় প্রমাণ বাংলার পুথি-সাহিত্য। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ‘সংকর’ সামাজিক-ধর্মীয় বিশ্বাস-আচারের দৃষ্টান্ত ধারণ করে আছে মধ্য যুগের বাংলা (ও অন্য ভাষার) পুঁথিসমূহ। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের যুক্ত সাধনা’; রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ‘হান্ড্রেড সংস অব কবীর’ অনুবাদ; দুই বাংলার বাউল-ফকির ঘরানার গান বড় নিদর্শন। যেমন, দাদূ ও কবীর ছিলেন ‘সংকর’ ঐতিহ্যের প্রতীক। এক জায়গায় কবীর বলছেন, ‘আমি সংস্কৃত ভাষা শিখেছি যাতে করে সবাই আমাকে জ্ঞানী বলতে পারে, কিন্তু এই ভাষা শিখে কী লাভ যখন আমি দিকশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি?’ এর কয়েক শতাব্দী পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আত্মজীবনী’ লিখতে গিয়ে শুধু উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তৃপ্ত হবেন না; তিনি পরে পরেই ফিরে যাবেন হাফিজের বাণীর কাছে। এক জায়গায় দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন কী করে তিনি সিমলার শীতের রাত্রিতে আরাধনার কালে ব্রহ্মসংগীত ও হাফিজের গান একই সাথে করতেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু ‘সংকর ঐতিহ্যের’ স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে তাতে :
‘আমি কম্বল জড়াইয়া বিছানায় বসিয়া সকল ভুলিয়া অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত ব্রহ্মসংগীত ও হাফেজের কবিতা গান করিতাম-
য়া রব, আঁ শমে শব্-আফ্রোজ কে কাশানা-এ-কীস্ত্?
জানে-মা গোখ্ৎ বে-পুর্সীদ কে জানানা-এ-কীস্ত্?
[অর্থাৎ] যে দীপ রাত্রিকে দিন করে, সে দীপ কাহার ঘরে?
আমার তো তাতে প্রাণ দগ্ধ হলো, জিজ্ঞাসা করি তাহা প্রিয় হলো কার?’
হাফিজের প্রতি মুগ্ধতা দেবেন্দ্রনাথের লেখার ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়েছে (আমি শুধু স্থানাভাবে দেবেন্দ্রনাথের অনুবাদে হাফিজের বাংলাটাই তুলে ধরছি) :
‘আজ আমার ও সভাতে দীপ আনিও না।
আজিকার রাত্রিতে সেই পূর্ণচন্দ্র আমার বন্ধু এখানে বিরাজমান।’
তারপর দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, যাহা মূলতত্ত্ব, তাহার উল্টা ভাবনা মনেতেও স্থান পাইতে পারে না; তাহা কোনো মনুষ্যের ব্যক্তিগত সংস্কার নহে, তাহা সকল কালে নির্বিশেষে সর্ববাদী-সম্মত; মূলতত্ত্বের প্রামাণিকতা আর কাহারো উপর নির্ভর করে না। তাহা আপনি আপনার প্রমাণ। তাহা স্বতঃসিদ্ধ, যেহেতু ইহা আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাতে প্রতিষ্ঠিত।’
একই লেখাতে/স্তবকে দেবেন্দ্রনাথ উপনিষদ ও হাফিজের গানকে সাক্ষী মানছেন এটাও তাৎপর্য্যপূর্ণ :
‘আমার প্রতি উপনিষদের উপদেশ এই :
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং। ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন কর। আমি ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন করিলাম। আমি এই তিমিরাতীত আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে জানিয়াছি।’
এটা বলেই তিনি আবারও হাফিজের শরণাপন্ন হলেন :
‘বাদ্ অজ্-ঈ র্নূ ব-আফাক দেহেম অজ্ দিলে খেশ্,
কে ব-খুর্শীদ্ রসীদেম্ ও গোর্রা আর্খি শুদ্।
[অর্থাৎ] এখন অবধি জ্যোতি আমার হৃদয় হইতে পৃথিবীতে ছড়াইব, যেহেতুক আমি সূর্য্যেতে পঁহুছিয়াছি ও অন্ধকার বিনাশ হইয়াছে।’
মধ্যযুগের কবীর বা ঊনবিংশ শতকের দেবেন্দ্রনাথ কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন হিন্দু-মুসলিম যুক্ত সাধনার ও ‘সংকর’ সামাজিক ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে। দীনেশচন্দ্র সেন ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মুসলমানদের অবদান’ গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন :
‘আমরা শিক্ষিত-সম্প্রদায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের মালিক। খনির মধ্যে খনির ন্যায় আমাদের পল্লীতে পল্লীতে বঙ্গ-ভারতীয় যে অজস্র দান পড়িয়া আছে তাহা আমরা দেখি নাই, শুনি নাই … এইরূপ শত শত গীতিকা ও কথা আছে। তাহাদের অনেকগুলি নবম দশম শতাব্দীর; হিন্দু-মুসলমানের পৃথক ছাপমারা তাহারা নয়- তাহারা উভয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব। এই বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক বাঙালী। আমি শুধু মুসলমান কবিদের কয়েকটি রচনার নমুনা দিলাম, তাহাও অতি অল্প সংখ্যক। অপ্রকাশিত বহু গীতিকা আমার কাছেই আছে- বাঙালার পল্লী-দরদী লোক যদি খুঁজিয়া বেড়ান, তবে এখনও বৃদ্ধ গায়েন অনেকে আছেন- যাহাদের নিকট হইতে এখনও শত শত কাহিনি ও গীতিকার উদ্ধার হইতে পারে। … হিন্দুদের রচিত মহুয়া, কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী, কমলা, কেনারাম, মালঞ্চমালা প্রভৃতি অনেক গীতিকা ও রূপকথা আছে- মূলত তাহাদের সঙ্গে মুসলমানগণের রচিত কাব্যগুলোর প্রভেদ অল্প- একই ধাঁচের লেখা, একই সুর, একই আদর্শ।’ এই যে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত-সাধনা- এই অভিন্ন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্য- এটিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটি দিক। ধর্মনিরপেক্ষতার এই মিলিত চর্চার সাংস্কৃতিক পটভূমিটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এজন্যেই ‘হাসিনা’ তথ্যচিত্রে যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান বেজে ওঠে (পান্নালালের গাওয়া) ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’, তখন সুরেই আবিষ্ট হয়ে থাকি আমরা। এটা যে শ্যামা-সংগীত কে তার ধার ধারতে এসেছে? বঙ্গবন্ধুর মানস-গঠনে এই হিন্দু-মুসলিম একত্র-সংস্কৃতির আবহাওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটা না বুঝলে শুধু সংস্কৃতি-বিরহিত শুস্ক তত্ত্ব-আদর্শের নিরিখে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির গূঢ় অর্থটি বোঝা যাবে না।
কেন অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ এত বড় করে দেখা দিয়েছিল তা একজন রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখছেন গোপালগঞ্জের জনৈক চন্দ্র ঘোষের কথা, যিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী :’জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হতো না। জুতা পরতেন না, খরম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন।’ এহেন ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তান আমলে। একসময় তাকে, শেখ মুজিবকে এবং ফণী মজুমদারকে একই সেলে রাখা হয়। সেবার বঙ্গবন্ধুর প্রচণ্ড জ্বর এলো জেলে :
“রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে, দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণী বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন। কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন ‘জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণী বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে?”
এই চন্দ্র বাবুকে আরেকবার ফরিদপুর জেলে পেলেন মুজিব। ততদিনে চন্দ্র বাবুর শরীরের চরম অবনতি হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে অনুমতি দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই। সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’ চন্দ্র ঘোষ তরুণ মুজিবুরকে বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনো দিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।”
এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’
[ক্রমশ]