বাজেট নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি; আমরা আসলে বাজেট নিয়ে আলোচনা করি না। অর্থনীতি, সমাজ, গোটা রাষ্ট্রই কেমন চলছে- সবকিছু নিয়েই আমরা আমাদের নাগরিক মতামত রাখি, উদ্বিগ্ন হই; সাফল্যে-অর্জনে উদ্বেলিত হই। এ বছরের বাজেট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তির সময়ে এ বাজেট এসেছে। করোনার বিশ্বব্যাপী অভিঘাতের দ্বিতীয় বছরের কালে এ বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের দশম ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন- ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করার।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতক উদযাপনের বছরে এসেছে এই বাজেট। তলাবিহীন ঝুড়ি, উন্নয়নের পরীক্ষা-ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ-ঝুঁকির প্রতীক, দুর্নীতির দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন ইত্যাদি অভিযোগের পর অভিযোগে আক্রান্ত ছিল একদা বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি। সেখান থেকে আমরা কয়েক বছর আগেই বেরিয়ে এসেছি। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। অতি সম্প্রতি আমাদের উত্তরণ ঘটেছে স্বল্পোন্নত এলডিসিভুক্ত গ্রুপ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মূল স্রোতধারায়। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির বিচারে আমরা বহুদিন ধরে বিশ্বের প্রথম ২০টি দেশের ভেতরে। কভিডের আগের অবস্থায় আমরা ছিলাম দশকে দশকে ক্রমাগতভাবে বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমরা বেড়ে উঠেছি চার/সাড়ে চার শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার থেকে বিশ্বস্তভাবে ছয়/সাড়ে ছয়, সাত/সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে (শেষের দিকে আট শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাও ছুঁয়েছি আমরা)। ২০০০ সালে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনেক নিচে; এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়
পাকিস্তানের দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার (১.৯০ পিপিপি ডলারের মানদণ্ডে) ছিল ১৫ শতাংশ; সে সময়ে ভারতের চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। আয়-প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ছাড়াও মেয়েদের স্কুলগামিতার হার, শিশু-অপুষ্টির হার, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার প্রভৃতি সামাজিক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ায় (শ্রীলঙ্কাকে বাদ দিলে) আমরা এগিয়ে আছি। আর আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় তো যোজন যোজন এগিয়ে। তারপরও জাতি হিসেবে প্রতি বছর বাজেট এলেই বাংলাদেশের জনসমাজ- শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আলোড়িত হয়- এটা শুধু আমাদের তর্কপ্রিয় স্বভাবকেই ইঙ্গিত করে না। দার্শনিকরা যাকে বলেছেন ‘পাবলিক রিজন’- সেই নাগরিক-বোধ আমাদের দেশে অন্য অনেক সমাজের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। শানিত ও তীক্ষষ্ট। আমাদের দেখভালের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করি না। ‘গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে’; আমরা সেই সাহসী উদ্দাম জাতির বংশধর। নিজেদের বিষয়-আশয় আমরা নিজেরাই বুঝে নিতে প্রস্তুত। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় সরকারের সাহায্য এলে ভালো। কিন্তুযদি না-ও আসে, তাতে আমরা বসে নেই। আমরা শৃঙ্খলভাঙা দ্রাবিড় তিমিরবিনাশী জাতি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন জনবসতির দেশ; তাও তেমন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া। কিন্তু এই স্বল্প-সম্পদ ও উচ্চ-ঝুঁকির ঘন জনবসতির দেশে বাস করেও- হয়তো বাস করি বলেই আমরা ডেসপারেটভাবে নির্ভীক, উদ্যমপরায়ণ জাতি। এ জন্যই করোনার বছরেও আমরা নুয়ে পড়ি না; আমাদের শ্রমিকদের বিদেশ থেকে পাঠানো রক্ত জল করা অর্থ সমস্ত পরিসংখ্যানগত প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়; আমাদের কৃষকরা নিত্যনতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে নতুনতর প্রযুক্তি আশ্রয় করে সৃষ্টি করে দেন কৃষি ও খাদ্য-নিরাপত্তার এক বিশাল মজবুত সামাজিক সুরক্ষার পাটাতন। আমাদের পোশাকশিল্পের তরুণ প্রজন্মের নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা করোনাকে উপেক্ষা করে হাসিমুখে টিকিয়ে রাখেন রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা। আরভিন আদিগার উপন্যাসে একটি ‘হোয়াইট টাইগার’-এর বর্ণনা ছিল। এদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিজনকেই আমার মনে হয় একেকটি হোয়াইট টাইগার। উদ্যমী, ভ্রূক্ষেপহীন, সুযোগ সন্ধানে তৎপর, কষ্টসহিষ্ণু, আশা ও উচ্চাশায় বুক বেঁধে থাকা প্রাণ। এদেশকে পিছু টেনে রাখা অসম্ভব। এই অন্তর্নিহিত ‘সামাজিক পুঁজি’ সচরাচর বাজেট আলোচনায় ধরা পড়ে না।
২.
কভিড-১৯ বাংলাদেশকে (ও বিশ্বকে) আঘাত করার একটি বছর পেরিয়েছে। এরই মধ্যে আমরা করোনার একটি বড় ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছি। ২০২১-২২ সালের বাজেট দেওয়ার দু’মাস আগেই আমরা করোনার আরেকটি ঢেউকে আসতে দেখেছি। এটি সহসাই আমাদের করোনায় মৃত্যুসংখ্যাকে ১০০-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিল; সংক্রমণের হারকেও উন্নীত করছিল ২০ শতাংশের ওপরে। সার্বিকভাবে পরবর্তী আংশিক লকডাউনের (এবং বর্ডার বন্ধ করে দেওয়ায়) কারণে করোনার মাত্রা এখন অনেক কমে এসেছে। এটা স্বস্তিদায়ক সংবাদ, যদিও নীতিনির্ধারকরা নজর রাখছেন বর্ডার এলাকার জেলাগুলোর দিকে; পাছে সেখানে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ করোনা এখনও আমাদের দুর্ভাবনার প্রধানতম বিষয় হয়ে থাকছে। এই বাজেটেও সেটা থেকেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বক্তৃতায় এটি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত ১২ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে আমরা দারিদ্র্য দূর করে ও স্বল্প-উন্নত দেশের তালিকা হতে বেরিয়ে এসে একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে যাত্রা করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করোনাভাইরাসজনিত সংকট আমাদের অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ করোনার দ্বিতীয় বছরের মধ্যে আমরা আছি, এবং পরিস্থিতির বিচারে মনে হয় যে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। যতদিন দেশের অধিকাংশ জনগণকে আমরা টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে না পারব এবং যতদিন বিশ্বজুড়ে কভিডের ছায়া অপসৃত না হবে, ততদিনই এই অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। এটাই বাস্তবতা। এ জন্যই গত বছরের বাজেটের মতো এ বছরের বাজেটকেও আমি বলতে চাই ‘ঝুঁকি মোকাবিলা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বাজেট’। অর্থাৎ এখানে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো মূল লক্ষ্য না- যদি বাড়ে তো ভালোই, তবে পরিকল্পনাবিদ বা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশামতো না বাড়লেও ক্ষতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনকল্যাণের দিকে চোখ রেখে সামগ্রিকভাবে করোনার ঝুঁকি সামাল দেওয়া যাচ্ছে ও অর্থনীতির ওপরে সেই করোনার ঝুঁকির অভিঘাতকে প্রশমিত করা যাচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্মানজনক মাত্রায়- বিশ্বব্যাংকের মতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এডিবির মতে ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ; সরকারি তথ্যমতে আনুমানিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বিপরীতে, ভারতের অর্থনীতিতে কোনো পজিটিভ প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, বরং সংকোচন (নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি) ঘটেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ বা ৫ প্রবৃদ্ধি হার যা-ই হোক না কেন, এটা অর্জিত হয়েছে তিনটি প্রধান ফ্যাক্টরের কারণে। এই তিনটি ফ্যাক্টর হলো- যথাক্রমে কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি। এই তিনটি আয়ের উৎসই গ্রামীণ দারিদ্র্য কমায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। এবং সেটাই ঘটেছে বাংলাদেশে। ২০২০ সালের প্রতি ত্রৈমাসিকের জন্য আমরা দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করেছিলাম। তাতে প্রথম প্রান্তিকে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ২০ শতাংশ। কভিডের প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা এক লাফে চলে যায় ২৯ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে আসে ২৭ শতাংশে, এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। চারটি প্রান্তিক মিলিয়ে সারা বছরের গড় দারিদ্র্য দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ২৪ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। একইভাবে ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্যের হার চার প্রান্তিক মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ১৩ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কভিড আমাদের পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০২০-এর মধ্যে দারিদ্র্য-পরিস্থিতিতে কোনো সামগ্রিক অগ্রগতি হয়নি। বরং চরম দারিদ্র্য কিছুটা বেড়েছে।
আমাদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই যে পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে যাওয়া- এটি হচ্ছে কর্কশ বাস্তবতা। এর ফলে অন্য সব লক্ষ্যমাত্রা থেকেও আমরা পিছিয়ে পড়ব। কভিডের আগে যেভাবে উন্নয়নের ধারা চলছিল, তাতে ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-১ (জিরো পভার্টি) অর্জন করা কঠিন ছিল না আমাদের। আগামী ১০ বছর গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করলেই তা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন তা এত সহজ হবে না। যদি আগামী ১০ বছর গড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করি (এ বছরের বাজেটে যেটা ধরা হয়েছে) তাহলেও ২০৩০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে যাবে। একই কথা খাটে অন্যান্য নন-ইনকাম সূচক তথা শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ক্ষেত্রেও। তাহলে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে? প্রথমত, শুধু প্রবৃদ্ধির সড়কের ওপরে নির্ভর না করে সরাসরি আঘাত হানতে হবে, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন ডাইরেক্ট ইনকাম ট্রান্সফার। এটা হতে পারে প্রত্যক্ষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অথবা ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে। এতে হয়তো বাজেট-ঘাটতি জিডিপির স্বাভাবিক ৪-৫ শতাংশের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। যেমনটা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে বা প্রস্তাবিত হচ্ছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের ক্ষেত্রে। এই দুটো বছরেই বাজেট ঘাটতি থাকছে জিডিপির ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে। কিন্তু এই বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেয়াড়া রকমের বেশি নয়। ভারতের ক্ষেত্রে সংকটের বছরে এই ঘাটতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের প্রধান স্বয়ং বলেছেন, এই ঘাটতি সংকট মোকাবিলায় এমনকি ১০ শতাংশ হলেও দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। দেখা যাচ্ছে, মনিটারিস্ট আর কেইনসীয়দের মধ্যে যুদ্ধে আপাতত কেইনসীয়দের পক্ষেই পাল্লা ভারি। সেটা খোদ বিশ্বজুড়েই। আশার কথা, আমরা বহুকাল পরে সাহস করে ওয়াশিংটন কনসেন্সাস থেকে বেরিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের কথা বলতে পারছি এবং স্বয়ং অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় এটি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, শুধু ঘাটতি-অর্থায়ন করাই যথেষ্ট নয়। অর্থের সদ্ব্যবহারও করা চাই। এ ব্যাপারে সবাই কম-বেশি একমত- মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খামতি আছে। কভিডের বছরে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যয় সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই চাচ্ছে, এই কভিডের সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য দপ্তর ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাস্তবিকই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পারঙ্গম জনস্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠুক। এই একটি বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ জনগণ আশা করে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোরও মাস্ক ইত্যাদি কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
৩.
আসলে অনেকেই চাইছেন করোনাকে উপলক্ষ করে পুরো অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সিস্টেমকেই সংস্কার করতে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক অর্থে এরা পুঁজিবাদের মধ্যে দুটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রথমটি রক্ষণশীল পুঁজিবাদের ধারা, দ্বিতীয়টি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারা। একাংশ চাইছেন পুরোনো ধারাই অব্যাহত রাখতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নিকট অতীতের ধারা অনুসরণ করে যেহেতু ভালো অর্জন করা গেছে- মধ্যম আয়ের স্তরে প্রবেশ করা গেছে, দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেগবান হয়েছে, অবকাঠামোর চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে- সেহেতু এই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনার দরকার কী? এরা প্রবৃদ্ধির মূল কাঠামোটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কভিডের বছরে কিছু নতুন উপাদান সংযোজন করতে চান। যেমন, স্টিমুলাস কর্মসূচি, অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও রিলিফ কর্মসূচি ইত্যাদি। স্বাস্থ্য খাতেও এরা ‘সংস্কার’ চান, তবে সেটা ‘যুগান্তকারী’ কিছু নয়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে যেমন সংস্কার করতে হয় সেরকমই কিছু করতে অভিলাষী তারা।
দ্বিতীয় ধারার নীতি-আলোচকরা করোনার সংকটকে সিস্টেম পরিবর্তন করার একটা ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন। তারা চান গতিশীল নেতৃত্বে জনস্বাস্থ্য খাতকে ওয়েলফেয়ার স্টেট মডেলে ঢেলে সাজাতে, নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র করতে কম্যুনিটি হেলথ ক্লিনিকের কায়দায়। প্রতিটি জেলা শহরে ভালো করোনা চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে এবং পর্যাপ্ত টেস্টের ব্যবস্থা করতে। ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনিশিয়ানেরও যথেষ্ট সরবরাহ বাড়াতে। বেসরকারি খাতকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাজে আরও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে। অনিশ্চয়তার কভিডের ওপরে দেশে গবেষণাচর্চাকে উৎসাহিত করতে। দেশের ভেতরেই করোনার টিকা উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে। প্রণোদনা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে এরা বৈষম্য, দুর্নীতি ও বঞ্চনা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ। এদের কথাটাও অর্থমন্ত্রীর শোনা দরকার। আমরা শুধু ‘ওয়েলফেয়ার’ বিতরণ করতে চাই না; উন্নত দেশের মতো ওয়েলফেয়ার স্টেটও হতে চাই।
অর্থনীতিবিদ, মহাপরিচালক, বিআইডিএস