পর্ব :: ৮৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বঙ্গবন্ধু নাগরিকের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও ‘অধিকারের’ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রের বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল- সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান করা এবং ক্রমান্বয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (যেটা এখন এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রায় বিধৃত হয়েছে)। ডানপন্থীদের অভিযোগ হলো তাহলে ১৯৭২ সালে এত তড়িঘড়ি করে কেনই-বা ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো? প্রথমত, পুঁজির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সম্পদের অধিকতর সুষম বন্টন নিশ্চিত করা দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বাইশ পরিবারের মতো অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটুক, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননি। এজন্যই, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তি-পুঁজিকে সর্বতো উপায়ে সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু বৃহৎ ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কালক্রমে (১৯৭৪ সালেই) বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির ‘সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা তখনকার দিনের বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার বিকাশের জন্য যথেষ্ট পরিসরই দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ ‘রপ্তানিমূলক’ শিল্পে এবং সাম্প্রতিক দশকে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখিন’ শিল্পে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, সুস্থ ব্যক্তি খাতের বিকাশের পথে বিনিয়োগের সিলিং-জনিত প্রতিবন্ধকতা কৃত্রিম ভাবে আরোপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ব্যক্তি-পুঁজির ওপরে রাষ্ট্রের ‘নজরদারি’র প্রয়োজনীয়তাও সেই সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে? ‘মার্কেট-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া এবং ‘বিজনেস-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া তো সমার্থক শব্দ নয়। ২০১০ এর দশকের অভিজ্ঞতা এখানে মিশ্র তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে। ব্যক্তি খাতের সাফল্যের পাশাপাশি সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তি খাতের দায়-দেনাও (Default) বিস্তর এবং ক্রমবর্ধমান। যে হারে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে ২০১০ এর দশকে, সেই হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি (৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী এই অনুপাত জিডিপির ৮ শতাংশেই থমকে আছে)। ফলে সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বা Common Goods সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। ‘মার্কেট-ইকোনমি’ হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন অতি দ্রুত ‘মার্কেট-সোসাইটি’তে পরিণত হচ্ছি। মার্কেট-ইকোনমি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এদেশে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা যেন উত্তরোত্তর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে কেবল মার্কেট-সোসাইটিতে রূপান্তরিত না হই। শেষোক্ত সমাজে সবকিছু, সব মূল্যবোধই, শেষপর্যন্ত ‘কেনা-বেচা’র সামগ্রীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে- সেটা বিদ্যাদান, চিকিৎসা দান থেকে শুরু করে ‘সামাজিক উদ্যোগ’, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রম পর্যন্ত। এ ধরনের সমাজ শেষাবধি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি থাকে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে এ ধরনের ডিস্টোপিয়ান ‘মার্কেট-সোসাইটি’র কোনো স্থান ছিল না। এজন্যই তাকে জনগণের তদারকি, জনগণের মালিকানা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে তার অবস্থান নৈয়ায়িক দার্শনিক জন রাউলস, অমর্ত্য সেন ও মাইকেল স্যান্ডেলের অনুবর্তী। আমাদের সমাজের স্বভাবজ ধর্মবিহিত মূল্যবোধ এই অবস্থানের প্রতিই সমর্থন জানায়।
সংবিধানের ২০নং অনুচ্ছেদের যোগ্য/ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার বন্টননীতির পেছনে সরাসরিভাবে অন্যবিধ সূত্রের প্রভাবও কাজ করেছিলো। বাহাত্তরের গণপরিষদ বিতর্কে বেরিয়ে এসেছিলো যে এর সাথে সোভিয়েতের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণত, সোভিয়েত ইউনিয়নের উক্ত সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিলো : ুঞযব ঢ়ৎরহপরঢ়ষব ধঢ়ঢ়ষরবফ রহ :যব টঝঝজ রং : “The principle applied in the USSR is that of socialism: ÔFrom each according to his ability, to each according to his work.”
এটা বাহাত্তর সালে গণপরিষদ বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু সেটা ২০ (১) অনুচ্ছেদে এই শ্রম-অনুযায়ী বণ্টনের নীতি অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ১৯৩৬ সালের সোভিয়েত সংবিধান বিবেচনায় নেওয়া ছাড়াও অন্য অনেক দেশের সংবিধানের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেছিলেন। এ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ৩০ অক্টোবর ১৯৭২ ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন :
‘প্রথমে আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই, যে মূলনীতিকে আমরা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি, সেই মূলনীতির আদর্শের ভিত্তিতে আমরা সংবিধান রচনা করেছি। যাঁরা তা স্বীকার করবে না, তাঁদেরকে আমি গোটা সংবিধান নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে বলব। আমার মনে হয়, এই সব সমালোচনা করার আগে তাঁরা যদি অন্যান্য দেশের সংবিধান পরীক্ষা করে দেখতেন, তাহলে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটত। তাহলে উপযুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা সংবিধানটি বিচার করতে পারতেন।’
কোন কোন দেশের সংবিধান সেদিনের সংসদে আলোচনা হয়েছিল? সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাজউদ্দীন আহমদ, আছাদুজ্জামান খান প্রমুখ জিডিআর অর্থাৎ, পূর্ব জার্মানির ১৯৪৯ সালের সংবিধানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের উদাহরণ এসেছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ থেকে। অন্যান্য দেশের মধ্যে বড় করে এসেছিল চীন, পশ্চিম জার্মানি ও জাপানের কথা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। বার কয়েক অবশ্য লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রায় সকলেই অবগত ও সচেতন ছিলেন। একটি উদাহরণ দেই। গণপরিষদ সদস্য আবু মো: সুবেদ আলী (ঢাকা-১০) সংবিধানের মডেল কোন দেশ থেকে এসেছে ঐ প্রশ্নে বলেছিলেন: “আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করিনি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটেও’ বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করিনি।” অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সবার অভিজ্ঞতাই বিবেচনায় নিয়েছিল, কিন্তু অভিপ্রায়ে এবং নির্মাণে এটি ছিল একান্তভাবেই বাংলাদেশের মনোভূমি ও ভূগোল-ইতিহাসের ফসল। একটা প্রশ্ন এখানে না এসে পারে না। এই যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার দিকে হাত বাড়ানো- তা কি একই ইস্যুতে, নাকি নানা ইস্যুতে?
প্রথমত, জিডিআর, পোল্যান্ড ও চীনের প্রসঙ্গ এসেছিল ‘মিশ্র মালিকানা’ ব্যবস্থার ন্যায্যতা সপ্রমাণিত করতে। এই তিনটি দেশই সমাজতান্ত্রিক হয়েও মিশ্র-মালিকানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিল। এটা প্রমাণ করার জন্য গণপরিষদের সদস্যরা এসব দেশের সংবিধান থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, লিবার্টি প্রিন্সিপালের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ যে আরোপ করা প্রয়োজন তা প্রমাণ করার জন্য পূর্ব ইউরোপীয় ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সংবিধানের ধারাসমূহের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। এর থেকে বাদ পড়েনি জাপানের সংবিধানও। মৌলিক অধিকারের চৌহদ্দি বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাপানের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। যেমন, জাপানের সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : :‘These fundamental human rights guaranteed to the people by this constitution shall be conferred upon the people of this and future generations as eternal and inviolate rights.’ কিন্তু ১২নং অনুচ্ছেদে তার পরক্ষণেই বলা হয়েছে :‘The freedom and rights … shall be maintained by the constant endeavour of the people who shall refrain from any abuse of these freedoms and rights and shall always be repressible for utilizing them for the public welfare.’ এই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানেও।
[ক্রমশ]