বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৬৮


বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন যে, ইতিহাস এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক উদাহরণ দিয়ে তিনি যত যুক্তিজালই বিস্তার করুন না কেন ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হবে না। আইয়ুব খান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ছয় দফা বা সিক্স পয়েন্টের দাবির মুখোমুখি হবেন ওয়ান পয়েন্টের মাধ্যমে। আর সেটা হবে ‘গান পয়েন্ট’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মুজিবকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল। তার পরও তিনি ৬ দফা কর্মসূচিকে সামনে তুলে ধরেছিলেন সেটা কেবলমাত্র পূর্ব বাংলার মুক্তির সংগ্রামে ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন জড়ো করার জন্যে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী যে সহজে ৬ দফার দাবি মানবে না তা তিনি জানতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানতেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। সহজে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী ভারতকে অখণ্ড রেখে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ছিল অপেক্ষাকৃত ভারমুক্ত ‘কেন্দ্র’ (ইউনিয়ন) এবং বিকেন্দ্রীভূত শক্তিশালী ‘স্টেটস’ সমবায়ে একটি ফেডারেশন গঠন। সেদিন কংগ্রেস এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভেস্তে যায়। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখারও একমাত্র উপায় ছিল তেমনি একটি ভারমুক্ত কেন্দ্র (ফেডারেশন) রেখে এর প্রদেশগুলোকে ৬ দফার আলোকে শক্তিশালী বিকেন্দ্রীভূত ‘স্টেটসে’ পরিণত করা। পাকিস্তানের জন্য এটা আরও বেশি জরুরি ছিল। কেননা এর দুই অংশের মধ্যে বিরাজ করছিল দেড় হাজার মাইলের ভৌগোলিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক- মানসিক দূরত্ব। এক-অর্থনীতির অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকে ইতিমধ্যে সৃষ্ট আয়-বৈষম্য দূরীকৃত করা দুরূহ ছিল। অর্থনীতির একটি স্বীকৃত সূত্র হচ্ছে যে, অনগ্রসর ও অগ্রসর অঞ্চলের মধ্যে আয়-বৈষম্য দূর করা সম্ভব যদি দুই অঞ্চলের মধ্যে শ্রমের অবাধ সচলতা বা  Labour Mobility থাকে। বিশাল ভৌগলিক ব্যবধানের কারণে সেটা সম্ভব ছিল না। এত বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আর কোথাও দুই ভূগোলের দুই জনগোষ্ঠী একত্রে এক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। সুতরাং ৬ দফা মেনে না নিলে পাকিস্তান ভাঙার দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপরে না পড়ে তা পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীরই ওপরে পড়ে যায় বা তার ওপরে বর্তাবে (ঠিক যেমনটা ভারত বিভাগের মূল দায়ভার এসে পড়েছিল কংগ্রেস তথা তৎকালীন নেহরু-প্যাটেলের নেতৃত্বের ওপরে)- এটা পূর্বাহ্নেই অনুমান করা কষ্টসাধ্য ছিল বা মুজিবের পক্ষে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তান যেন ভেঙে যাবে এটা জেনে-বুঝেই কি বঙ্গবন্ধু তাহলে ৬ দফা দিয়েছিলেন? আমার বিশ্বাস, এ রকমটাই ভেবেছিলেন মুজিব। কিছু কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এমন ইঙ্গিত মেলে যে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই এমনকি তাকে ত্বরান্বিত করার জন্যই ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতির দাবা খেলায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাস্তবিকই মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট এক। একটি প্রমাণ এখানে উল্লেখ করব। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও তার কয়েকজন পেশাজীবী সহকর্মী মিলে তখন সত্তরের নির্বাচনে জয়ের পরে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। ৬ দফা দলিল যদিও মুজিবের মাথা থেকেই বের হয়েছিল, কিন্তু তারই দেওয়া ডিকটেশন ও গাইডলাইন অনুসরণ কওে দলিলটি লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের টিমেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। যা হোক, এক পর্যায়ে তারা অনুভব করলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা দাঁড় করানো গেলেও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সেরকম একটি ফেডারেশন আখেরে ‘সাসটেইনেবল’ হবে না। অর্থনৈতিক কার্যকারণ সূত্রেই সে ধরনের প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কিছুকালের মধ্যেই ভেঙে যেতে বাধ্য। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, ৬ দফা আপাতদৃষ্টিতে ‘বাঁচার কর্মসূচি’ হিসেবে অধিকার আদায়ের জন্য পেশ হলেও এর আসল অর্থ ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত করা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। রেহমান সোবহান তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, টেকনিক্যালি ৬ দফাকে ফেডারেল শাসনতন্ত্রের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত এবং কার্যকর করা যেত, তবে তার জন্য পিন্ডির শাসকদের তরফ থেকে সদিচ্ছার দরকার ছিল :: ‘Our arguments indicated that a valid Constitution, which accommodated the 6-point demands, could be made operational, provided that the military, were sincere about seeking a constitutional solution to the political crisis. Our affirmation contributed to strengthening Bangabandhu’s resolve to stand firm on 6 points as a credible negotiating option. This awareness did not prejudice Bangabandhu’s scepticism over whether the realization of 6 points would be peacefully conceded by the Pakistan junta.’
কিন্তু পিন্ডির শাসকচক্রের সমর্থন পেলেও ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে এক রাখা যেত না। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম-যিনি ৬ দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে ১৯৬৯ সাল থেকেই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন-তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন যে, শাসনতন্ত্রে ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও বা বাস্তবে বেশিদিন কার্যকর রাখা যেত না। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক রাষ্ট্রীয় ফেডারেল কাঠামো ‘দীর্ঘমেয়াদে’ টিকে থাকতে পারত না। কথাটা তিনি পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার অবগতির জন্য পেড়েছিলেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ এই যে, ‘আপনাদেরকে শাসনতন্ত্রের রূপরেখায় ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বলা হয়েছে। সেই কাজটা আপনারা করে দিন। তাতে করে পাকিস্তান আখেরে টিকবে কি টিকবে না, সে চিন্তাটা আমার উপরে ছেড়ে দিন।’ পরবর্তীকালে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ‘ঝরী- ‘Six-Point Programme or Independence?” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ফেডারেল কাঠামোর ভাঙন অনিবার্য ছিল। অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কেন ওই ধরনের ফেডারেল কাঠামো টিকতো না। ২০২০ সালে প্রকাশিত তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছে থেকে দেখা’ বইতে উপরোক্ত অর্থনৈতিক যুক্তির ভিত্তিতে তিনি এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি হচ্ছে প্রকারান্তরে এবং ‘বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে- একটা বিরাট পদক্ষেপ।’ পুরো উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে :
‘বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ১৯৭১-পরবর্তী পাকিস্তানের সংবিধানে [৬ দফার] এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৬ দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণ করার কাজ তিনি দিয়েছিলেন আমার কিছু সহকর্মী এবং আমাকে। … এই বিষয়গুলোর সঙ্গে তার নিজের যে লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা মিলে গিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য ছিল, সহজেই ভেঙে দেওয়া যায় এমন একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত জোট বা সংঘ তৈরি করা। … আলোচনার এক পর্যায়ে আমার মধ্যেই প্রশ্ন জাগে যে পরিচালনা কমিটির সবাই ছয় দফা দাবি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন কিনা। আমরা তাদের ছয় দফা বাস্তবায়নের সুদূরপ্রবাসী ফলাফলের বিষয়ে অবগত করানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করি। যখন আমাদের অনুশীলন শেষ হলো, তখন জানা গেল যে ইতিমধ্যে তারা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে এবং তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সবার আগে এবং খুব দ্রুত বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর কারণ এই যে, তিনি এ বিষয়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বেশি সময় ব্যয় করেছেন।’
স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে ৬ দফা স্বাধীনতা অর্জনের একটি মোক্ষম এবং শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর আশু নির্বাচনী Tactical তাৎপর্যও আমাদের মনে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়ন করে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য দর কষাকষির প্ল্যাটফর্ম হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও জাতীয়তাবাদী বোধে উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করতে হয়েছিলেন। তার এই চালে পাকিস্তান পড়েছিল ফাঁপরে। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তান এক পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যাবে- এটা জেনে তিনি ভেতরে ভেতরে আশ্বস্তবোধ করে থাকবেন। আর ৬ দফা অস্বীকার করে যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলের তথা জাতির ওপরে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে পূর্ব বাংলা অনিবার্যভাবেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে। বস্তুত ৬ দফা কর্মসূচির একটি রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানের সমগ্র সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে গিয়ে আবদ্ধ করেন শেখ মুজিব। উপরোক্ত যে কোনো  variant বাস্তবায়িত হলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকে- কিছু আগে বা পরে হলেও-ঠেকানো যেত না। এদিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে একজন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। এ জন্যেই ইতিপূর্বে তাকে অভিহিত করেছি একজন ‘মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বলে।
৬ দফার কর্মসূচি-সংক্রান্ত দলিল উত্থাপনের পরে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা’ (ম্যানিফেস্টো)-এর তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। সেখানে ইতিপূর্বে উল্লেখিত সকল গুরুত্বপূর্ণ সমতামুখীন নীতিমালাই স্থান পায়। ‘ছয় দফাভিত্তিক’ ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’কে শাসনতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লিবার্টি প্রিন্সিপলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলা হয় যে, দলটি ‘নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী’। ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে পুনরায় ঘোষিত হয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা। ১৯৬৭ সালের দলিলে এ সম্পর্কে লেখা হয় :
‘আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানে শোষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত হইতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’
পাঠক লক্ষ্য করুন, এটি কোনো ‘খসড়া ম্যানিফেস্টো’ থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে না। এটি দলের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ সংবলিত প্রকাশিত দলিল থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। অবশ্য ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ বলতে কী ধরনের অর্থনীতির সমাজ তার সংজ্ঞা এখানে নেই। কিন্তু অভিপ্রায়টা তো স্পষ্ট- ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা’ কায়েম করা। পাঠক আরও লক্ষ্য করুন, রাতারাতি সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে যে, এ ধরনের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই দলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’। এটাও লক্ষণীয় যে, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন শব্দবন্ধের পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীন’ শব্দটিও। ফ্রিডম বা লিবার্টি প্রিন্সিপল ছাড়া সোশ্যালিস্ট বা সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপল অচল- এই রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বঙ্গবন্ধু সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এটিই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ অন্যতম মূলনীতি।
১৯৬৭ সালের নীতি ও কর্মসূচির প্রকাশিত দলিলে যথারীতি এসেছিল ‘মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্পের’ জাতীয়করণের কথা। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ১৯৬৯ সালের ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণের আগেই আওয়ামী লীগ ব্যাংক-বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণের কথা বলেছিল এই দলিলে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিকাশকেও উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছিল : ব্যক্তি খাতের ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলধন সরবরাহ ও অন্য সকল ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের জন্য যেসব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, তার সবটাই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ১৯৬৭ সালে মুদ্রিত আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ দলিলেই রাখঢাক না করেই আগেভাগে বলে দেওয়া হয়েছিল। তার পরও কেন জাতীয়করণ নিয়ে সিভিল সোসাইটিতে এত উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল পরবর্তীকালে, তার কারণ বোঝা ভার। এর জন্যে  ‘Nationalisation and All that’ শীর্ষক রচনা লিখতে হয়েছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানকে বিষয়টা পরিস্কার করার জন্যে। এ প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই না উঠে পারে না। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদদের কেন ন্যাশনালাইজেশনের প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে (বা এখনও করতে হয়) সেটার কারণ বোঝা আরও দুরূহ। যদি বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের পূর্বাপর বিঘোষিত ও প্রতিশ্রুত ঘোষণা ও কর্মসূচিরই অংশ হয়ে থাকে, তবে তার জন্যে রাজনীতিবিদেরাই জবাবদিহি করবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
[ক্রমশ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s