পর্ব :: ৬৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১৯৬৪ সালের দলিলে কৃষি-ব্যবস্থা নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা হয়েছিল। কৃষকরা ‘দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত’ এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় Model Firm গড়ে তুলে তাদের ‘কৃষি উন্নয়নের আধুনিক পন্থা’ দেখাতে হবে- এসব বলার পর যেটা লেখা হয়েছিল, তা বর্তমান আলোচনার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ :
‘সমবায় পদ্ধতিতে আমাদের দেশে চাষাবাদের (Co-operative Cultivation) প্রচলন করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি কৃষকের জমি গড়ে এত ক্ষুদ্র এবং তাহাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দু’ভাগ যে, সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যতীত এখানে কৃষি উন্নয়নের অন্য কোনো উপায় নেই। কৃষি ব্যাংকের, কো-অপারেটিভ ব্যাংকের এবং অন্যান্য কৃষি ঋণের টাকা কৃষকদিগকে ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ না করিয়া সমবায় পদ্ধতির কৃষির জন্য উহা ব্যয় করা উচিত। ইহার ফলে কৃষকদের প্রধান সমস্যা- মূলধন সমস্যার সমাধান সম্ভব হইবে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ক্রয়, উন্নত বীজ ক্রয় এবং উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা সহজ হইবে।’
এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইতিপূর্বে (১৯৪৯-৫৩ পর্বে) আলোচিত সমবায়-চিন্তা আবারও পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ফিরে এসেছে। ‘Co-operative Cultivation’-এর প্রাথমিক ভাবনার বীজ তাহলে এখানেই রোপণ করা হয়েছিল, যা কালক্রমে বাহাত্তরের সংবিধানে ‘সমবায়ী মালিকানা’ রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় এবং পরবর্তীকালে বাকশালের ‘মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ’-এর ধারণার মধ্যে আরও স্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আকার লাভ করে। কৃষকদের করের ক্ষেত্রেও এই দলিলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে, ‘যেসব কৃষকের জমি ২৫ বিঘা বা তার নিল্ফেম্ন, তাহাদের জমির ওপর অন্তত ২৫ বৎসরকাল কোনো কর ধার্য করা হইবে না।’ এটিও স্বাধীনতার পরে করনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
তবে আন্তর্জাতিক নীতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১৯৬৪ সালের দলিলে সরাসরি কোথাও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য জোটনিরপেক্ষতার নীতি ‘Friendship to all, Malice to none’- পূর্বাপর বজায় ছিল। কিন্তু কৌশলগত বিবেচনা থেকে পূর্বেকার দলিলপত্রের মত কোথাও ইং-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব থেকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়নি। পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের মতো ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল শেখ মুজিব ও তার নিকট সহকর্মীদের। সেজন্যেই বোধকরি বিদেশনীতির ক্ষেত্রে পাই অপেক্ষাকৃত সংযত ও সতর্ক শব্দপ্রযোগ : ‘বিশ্ব শান্তি প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা দান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (Static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষে (Dynamic)- এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী।’ বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষেই একাধারে বাস্তববাদী ও জোটনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন। সেটা ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে তার বিভিন্ন উক্তিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। ‘কারও সাথে দুশমনি’ চাই না, দেশের উন্নয়নের জন্যে সকলকেই তার দরকার- এই বাস্তববাদী মনোভাব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পূর্বাপর অটুট ছিল। এমনকি যেসব দেশ তার জীবদ্দশায় স্বীকৃতি দেয়নি- যেমন, চীন ও সৌদি আরব- তাদের কাছেও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলি উপরোক্ত খসড়া ম্যানিফেস্টোর মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে। ইত্তেফাক পত্রিকা ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ এই প্রস্তাবগুলোর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। তা থেকে দেখা যায় যে, ১১নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন করিতে সক্ষম বলিয়া ধীরে ধীরে উহা প্রবর্তন’ করা প্রয়োজন। ‘ধীরে ধীরে’ শব্দের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এটাও লক্ষণীয়।
আগেই বলেছি, ১৯৬৬ সালে উত্থাপিত হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি। লেখক-শেখ মুজিবুর রহমান। এই দলিলের দফা ওয়ারী আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। যেটা প্রাসঙ্গিক সেটা হলো সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার। ৬ দফা কর্মসূচির ৬নং দফা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলছেন :
‘আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না।… যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তাহার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।’
এর থেকে বোঝা যায়, শেখ মুজিব ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে কী চোখে দেখতেন। প্রথমে ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’, এবং ক্রমান্বয়ে অতিমাত্রার ‘ব্যক্তিগত বৈষম্য’ (আয়, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য) দূর করার অভিপ্রায় ছিল তার। এখানেই ৬ দফা কর্মসূচির মধ্যে সমতামুখীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ৬ দফার মতো জাতীয় জাগরণের কর্মসূচি উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি সেই সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার কথা তুলতে ভোলেননি। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের আদর্শ বোঝার ক্ষেত্রে।
৬ দফার প্রসঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। যদিও ৬ দফা কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে পেশ করেছেন, কিন্তু এটি আসলে ছিল আমাদের স্বাধীনতারই দাবি। অর্থাৎ, বাহ্যত ‘অটোনমির’ কথা বলা হলেও তা আসলে ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের দিকেই অনিবার্যভাবে গড়াতো এ-ই হচ্ছে যুক্তি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম লিখেছেন যে, ‘৬ দফা কর্মসূচি পেয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, এর ফলে নামেই কেবল পাকিস্তান এক দেশ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে এটা হবে একটা বিরাট পদক্ষেপ’। আমি একটু এগিয়ে বলতে চাই। ৬ দফা বাহ্যত যা-ই হোক, কার্যত ছিল স্বাধীনতারই দাবি। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যেত। এই কথাটা কিছু ব্যাখ্যার দাবি করে। সরাসরি মুজিব ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি করতে পারতেন না এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। পূর্ব বাংলার মানুষ তখনও লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ বাইরে গিয়ে ‘স্বাধীনতা’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মনের দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোড়া থেকেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধতা করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : ‘আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম [১৯৪৯ সালের এই ম্যানিফেস্টো সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তৃত আলোচনা করেছি- লেখক] তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন।’ ১৯৫৩ সালের ‘সাংগঠনিক রিপোর্ট’ পেশ করার সময় মুজিব পুনরায় প্রসঙ্গটি স্মরণ করেন : “জেল-জুলুমের পরেও আওয়ামী লীগের অপ্রতিহত গতিতে ব্যাকুল হইয়া জনাব লিয়াকত আলীর মতো লোকও আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘শির কচাল দেঙ্গে’ ধ্বনি করিয়াও আওয়ামী লীগকে ভেস্তে দিতে পারেন নাই।” ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে মুজিব একই কথা বলেছেন : ‘নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সভায় ঘোষণা করলেন : ‘যো আওয়ামী লীগ করে গা, উচকো শির হাম কুচাল দে গা।’ আর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অধীনে স্বাধীনতা দূরে থাক, ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি তোলাও ছিল দেশদ্রোহের শামিল। তাই ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’ দলিলে সচেতনভাবেই ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে’র শব্দবন্ধ পর্যন্ত পরিহার করে বঙ্গবন্ধু কথাটা ঘুরিয়ে বলেছেন। তার একমাত্র Tactical দাবি ছিল- ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।’ ফেডারেটিং ইউনিটের জন্য যেসব আর্থিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা চেয়েছিলেন এবং তার সমর্থনে মুজিব যেসব ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক উদাহরণ টেনেছিলেন তা সত্যিই উপলব্ধির বিষয়। ইতিহাস ও যুক্তির ডায়ালেকটিক্যাল অ্যাপ্রোচের এটি ছিল একটি অনন্য উদাহরণ। প্রথমত, তিনি দেখালেন যে, ৬ দফা কোনো নতুন দাবি নয়। এটি লাহোর প্রস্তাবের আলোকে তৈরি। আর লাহোর প্রস্তাব ছিল ‘কায়েদে আজমসহ সকল নেতাদের দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা’ : ‘১৯৪৬ সালের নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়েছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।’ দ্বিতীয়, লাহোর প্রস্তাবের অরিজিনাল ভার্সনে ‘একাধিক স্টেটের সমন্বয়ে’ পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল- সেখানে ‘কেন্দ্রের’ কাছে কিছু দায়িত্ব রেখে বাদবাকি দায়িত্ব ‘স্টেটসমূহের’ কাছে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাতেও কেন্দ্রের কাছে তিনটি বিষয়- প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, ও মুদ্রানীতি রেখে বাদবাকি বিষয়ে প্রদেশগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তবে ৬ দফায় আরও ব্যাপক ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল :কেন্দ্রের কাছে বা ফেডারেশন সরকারে এখতিয়ারের কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার রেখে বাদবাকি সব বিষয় (আর্থিক নীতিসহ) স্টেটসমূহের কাছে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৩নং দফায় আলাদা মুদ্রানীতি ও ৪নং দফায় আলাদা রাজস্ব নীতির কথা বলা হয়েছিল। যেটা লক্ষণীয় যে, এই দুটির পক্ষেই যুক্তি হিসেবে মুজিব সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের সমসাময়িক উদাহরণ টেনে এনেছিলেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখানোর পাশাপাশি। যেমন, আলাদা মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলছেন :১৯৪৬ সালের ‘ক্যাবিনেট প্ল্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাহাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চালিতে পারে। কথাটি সত্য। … অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাহাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিকসমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রী দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে।’
৪নং দফার নিজস্ব রাজস্ব নীতি গ্রহণের পক্ষে একইভাবে ঐতিহাসিক (অর্থাৎ, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান) এবং সমসাময়িক (অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের) যুক্তি দিলেন মুজিব। ৬ দফায় দলিলে পরিস্কারভাবে লেখা আছে :
‘কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিধানে স্বীকৃত। তাহারা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই।
৩নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তাহার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েট ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নাই। তাহাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী ও পররাষ্ট্র দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই।’
৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপনের সময় মুজিব পাকিস্তানের ফেডারেশন কাঠামোয় পূর্ব বাংলাকে ‘প্রদেশ’ হিসেবে না দেখে ‘স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দলিলের সর্বত্র। এটাও কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। মুজিব জানতেন, ‘ইহাতে কায়েমি স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছেন যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। … মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাহাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত অ্যালার্জিক কেন?’
[ক্রমশ]