পর্ব ::১৬
পূর্ব প্রকাশের পর
এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছিল হাজারের এককে। তারপর মৃত্যু এত বেড়ে গেল- এই পরিসংখ্যানের প্রকাশ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল। তবু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের টনক নড়েনি। বাংলার কৃষককে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করাই তার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। ‘চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থে সে কথা মধুশ্রী মুখার্জি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বাংলার কৃষককূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার নীতির কারণে- এ কথা শোনার পর চার্চিল বলেছিলেন, ‘গান্ধী কি বেঁচে আছে এখনও? সে মারা যায় না কেন?’
তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের শিকার তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পেছনে চার্চিলের পরোক্ষ ভূমিকায় অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়বে। অনেকেই ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের’ সীমা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়বেন। এদের কারো কারো কাছে চার্চিল অবাধ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের মানসপুত্রের মত। তার সুস্বাদু ইতিহাস রচনা (যার জন্য সাহিত্যে নোবেলও পেয়েছিলেন তিনি) অস্বীকার করার নয়। যেমন নয় যুদ্ধকালীন সময়ে ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনুপ্রাণিত ভাষণ ও নেতৃত্ব। যুদ্ধ জয়ের পর রক্ষণশীল সরকারের পতন হল এবং তিনি আর প্রধানমন্ত্রী রইলেন না। এতেও দুঃখ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার নয় যে, চার্চিলের মত ‘লিবারেল’ রাজনীতিকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অমানবিক নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতা। ইংলন্ডকে বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতবর্ষ বা অন্যান্য উপনিবেশকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ফেলে দিতে দ্বিধা করেননি। যখন তিনি যুদ্ধোত্তরকালে একনাগাড়ে ছবি এঁকেছেন (এ কাজে দক্ষতা ছিল তার); একবারও আঁকেননি জয়নুলের মত কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। সেসব নিরন্ন মানুষের চিৎকার তার স্বপ্নের মধ্যে কখনো শোনা যেত কি-না এ বিবরণ জানা যায় না। ইউরোপের জন্য এক নিয়ম, আর উপনিবেশের মানুষদের বিচার করার ক্ষেত্রে অন্য নিরম- পার্থ চ্যাটার্জী যাকে বলেছেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’- তা চার্চিলের দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড বিশ্নেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক হিসেবে, এটিকেও ‘সত্তার বিভক্তি’ বলা যায়, যা ইতিপূর্বে আরেক জন ‘লিবারেল’ চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিলের আলোচনায় আমরা দেখেছি।
মধুশ্রী মুখার্জীর কাজকে অস্বীকার করা উপায় নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন নোবেল পদার্থ বিজ্ঞানী ইউইসিরো নাম্বুর অধীনে। পরে ক্যালটেক থেকে পোস্ট-ডক্টরেট করে বিখ্যাত ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ সাময়িকীর অন্যতম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বিজ্ঞান-বিষয়ক সাংবাদিকতা ও বই লেখাই তার প্রধান অভিনিবেশ। প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ নন ঠিকই, তাই বলে তিনি দুর্ভিক্ষের অঙ্ক কষতে জানেন না, একথা বলা যাবে না। ২০০২ সালে ব্রিটেনবাসীদের মধ্যে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জরিপে চার্চিল হয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ ইংরেজ’। এহেন ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গেলে সাহস ও দম উভয়ই থাকা চাই। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে যখন প্রস্তাব গেল যে, বাংলাকে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করার জন্য মাসে অন্তত ৮০,০০০ টন খাদ্যশস্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা চাই; চার্চিল সেই অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই তথ্য প্রাথমিক উপাত্ত ঘেঁটে মধুশ্রী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন তার বইয়ে। চার্চিলের এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারাও। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যেমন মনে করেছিলেন যে, ‘খাদ্যশস্য আমদানি হতে যাচ্ছে বাংলায়’- শুধুমাত্র এই খবরটি ছড়িয়ে দিলেও ‘মজুতদারির প্রবণতা কমে যেত ও চালের দাম নেমে আসত।’ অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পণ্যবাহী জাহাজের স্বল্পতা নিয়ে। কেননা, জাহাজগুলোকে তখন ব্রিটিশ উপকূলের আশে-পাশে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। মধুশ্রী বলেছেন যে, জাহাজের স্বল্পতার ‘টেকনিক্যাল আর্গুমেন্ট’ অনেকটাই কষ্ট কল্পিত। কেননা, ততদিনে মার্কিন প্রশাসন সাহায্য হিসেবে অনেক মালবাহী জাহাজ ব্রিটেনের কাছে স্থানান্তর করেছিল। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার খবরে এমনকি ইংরেজের শত্রুপক্ষে যুদ্ধরত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পর্যন্ত অধিকৃত বার্মা থেকে কিছু চাল বাংলাতে পাঠাতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সেন্সরশিপ সে তথ্যও পুরোপুরি চেপে যায়।
এবার আসি মূল্যস্ম্ফীতির প্রসঙ্গে। শুধু যে খাদ্য-সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে প্রতি মাসে মূল্যস্ম্ফীতির হার বাড়ছিল, তাই নয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সচেতনভাবে গৃহীত ম্যাক্রো-ইকোনমিক পদক্ষেপও। ২০১৮ সালের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ২০ অক্টোবর সংখ্যায় প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ও জওহরলাল বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক ঊষা পাটনায়েক অভিযোগ করেছেন যে, বাংলার দুর্ভিক্ষ এমনিতেই হয়নি। বাংলায় দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থায়নের যোগাড়-যন্ত্র করা হয়েছিল। মানুষের ভোগের পরিমাণ কমিয়ে যুদ্ধের রসদ যোগানোর জন্য বিনিয়োগের তহবিল বাড়ানো হয়েছিল। এই ম্যাক্রো-ইকোনমিক যুক্তিটি এসেছিল অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ কেইনসের লেখা থেকে। ‘ট্রিটিস অন মানি :দ্য এপ্লাইড থিওরি অব মানি’ (১৯৩০) এবং ‘হাউ টু পে ফর দ্য ওয়ার :এ রাডিকেল প্ল্যান ফর দ্য চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার’ (১৯৪০); এই দুটি লেখায় কেইনস এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কীভাবে জনগণের আয় (ভোগ) কমিয়ে তা থেকে উদ্বৃত্ত আহরণ করা যায় যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থায়নের জন্য, সেটা কেইনসের আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্রিটেনবাসীর ক্ষেত্রে এই মহৌষধির প্রয়োগ না করে তা ব্যবহার করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সাধারণ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের নিরীহ জনগণের ভোগ কমিয়ে তাদেরকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ তুলে নিয়েছিল চার্চিলের ইংরেজ সরকার। মধুশ্রী মুখার্জীর বইটি ও ঊষা পাটনায়েকের লেখাটিকে আমরা এই অর্থে সম্পূরক রচনা হিসেবে পাঠ করতে পারি।
মুখার্জী ও পাটনায়েকের লেখার মুখ্য প্রতিপাদ্যের সাথে অমর্ত্য সেন অপরিচিত নন। তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি সাতটি কারণের কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল চার্চিলের নিস্পৃহতাও। যেমন, তিনি বলছেন, ‘The refusal of the British Government to permit move food imports into India throngh reallocation of shipping as an emergency measure to tackle the famine was severely criticized. Lord wavell, who became the new Viceroy at the last stage of the famine and who had to battle hard for increasing food imports into India, went on record in this context that he felt that ‘the vital problems of India are being treated by his Majesty’s Government with neglect, even sometimes with hostility and contempt’- এই শেষোক্ত উদ্ৃব্দতিটির উৎস হচ্ছে লর্ড ওয়াভেলের চিঠি, ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবরে লেখা উইনস্টন চার্চিলকে উদ্দেশ করে। অন্যদিকে, ঊষা পাটনায়েকের যুক্তি- ‘ইচ্ছে করে মূল্যস্ম্ফীতি ঘটানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য’- সেটিও পরোক্ষভাবে অমর্ত্য সেনের চোখে পড়েছিল। তিনি লিখছেন ::’The 1943 famine can indeed be described as a ‘boom famine’ related to powerful inflationary pressures initiated by public expenditure expansion’. তবে সব কার্যকারণের মধ্যে সেনের প্রধান গুরুত্ব এসে পড়েছিল ‘বীপযধহমব বহঃরঃষবসবহঃ’র দ্রুত অবনতির ওপরে- সামগ্রিকভাবে খাদ্যের যোগানের সাংবৎসরিক বাড়া-কমার ওপরে নয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রাম-বাংলা, বিশেষত মজুরি-শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিক ও অসচ্ছল প্রান্তিক জোতের পরিবারেরা। এখানে সেনের মূল তর্কটা দুর্ভিক্ষের Causality বা বা মূল কার্যকারণসূত্র নিয়ে যখন দুর্ভিক্ষবিরোধী ‘পলিসির’ প্রসঙ্গ এসেছে তখন তিনিও খাদ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি, ফুড রেশনিং ব্যবস্থা, পাবলিক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, খাদ্যশস্যের মূল্য-পরিস্থিতিকে সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আনা ইত্যাদি ‘সাপ্লাই-সাইড’ কর্মসূচির ওপরে জোর দিয়েছেন তার বইতে যথাযথভাবেই। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে শুধু সরকারি প্রশাসক, ইতিহাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা অর্থনীতিবিদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট নয়। সমসাময়িক সাহিত্য-কর্মের মধ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষের চালচিত্র বিশ্বস্ততার সাথে ফুটে উঠেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ মন্ব্বন্তরের প্রাক-কথন থেকে এর ট্র্যাজিক পরিণতি অবধি পাত্র-পাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করেছিল। জাপানি আক্রমণের মুখে ১৯৪২ সালের মে মাসে ইংরেজরা বার্মা থেকে যখন পিছু হটল, তখন বার্মা থেকে চাল আমদানিও আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে দুর্গাপণ্ডিত আর গঙ্গাচরণের মধ্যে কথা হচ্ছে :
“- জাপানিরা সিঙ্গাপুর নিয়ে নিয়েছে? যুদ্ধের খবর কী?
– শুধু সিঙ্গাপুর কেন, ব্রহ্মদেশও নিয়ে নিয়েচে। জানো না সে খবর?
– না-ইয়ে-শুনি নি তো? ব্রহ্মদেশ? সে তো-
– যেখান থেকে রেঙ্গুন চাল আসে রে ভায়া। ওই যে সস্তা, মোটা মোটা আলো চাল …”
যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে চাল কেনার ধারা তো পূর্বাপর ছিলই, জাপানি আক্রমণের মুখে এই কেনার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। কোনভাবেই যেন জাপানিদের কাছে চালের বাজার না চলে যায় সে জন্যে ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরকে চাল কেনার অনুমতি দেয়। চাল বিক্রি করতে না চাইলে জবরদস্তিও হচ্ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে। এর ফলে কিছুটা অবস্থাপন্ন মানুষ যারা টাকা দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য রাখে, তারাও হাটে-দোকানে গিয়ে চাল পায়নি। যারা আরো অবস্থাপন্ন তাদর কাছে চাল থাকলেও চালের দাম আরো বাড়তে পারে- এই আশঙ্কায় তারাও চালের সংগ্রহ লুকিয়ে ফেলেছিল। এতে করে গঙ্গাচরণের মত ক্রয়-নির্ভর পরিবারদের অনাহারে-উপবাসের ঝুঁকিতে দিন কাটাতে হয়েছিল। বিভূতিভূষণ লিখছেন একের পর এক ঘনায়মান দুর্যোগের দৃশ্য :
১. ‘অনঙ্গ-বৌ বললে- আর দুটো ভাত মেখে নাও, ডাল দিয়ে পেট ভরে খাও-
-এ চাল দুটো ছিল বুঝি আগের দরুণ?
-হুঁ।
-কাল হবে?
-কাল হবে না। সকালে উঠেই চাল যোগাড় করো। রাতটা টেনেটুনে হয়ে গেল।
-সেই বিশ্বাস মশায়ের দরুণ ধানের চাল?
-হুঁ।
অনঙ্গ-বৌ স্বামী-পুত্রকে পেট ভরে খাইয়ে সে-রাতে এক ঘটি জল আর একটু গুড় খেয়ে উপোস করে রইলো।’
২. [পরের দিন গঙ্গাচরণ গেছে চালের খোঁজে। এক জায়গায় দেখল চাল বিক্রি হচ্ছে। একটু ক্ষণ আগেই গঙ্গাচরণ এক জেলে নবীন পাড়ূইকে বলেছে, ‘কখনো কি কেউ শুনেচে যে চালের মণ ষোল টাকা হবে।’ অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, এরই মধ্যে চালের দাম বেড়ে ‘কুড়ি টাকা মণ’ হয়ে গেছে।
[ক্রমশ]
Original in সমকাল