[তুমুল গাঢ় সমাচার ১২] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১২

পূর্ব প্রকাশের পর

অর্থনীতি ও সাহিত্যের অন্তর্লীন সম্পর্ক বিশেষ করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের আলোচনায়। ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপরে বিশেষজ্ঞ অমিয় কুমার বাগচী অমর্ত্য সেনের লেখার এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ১৯৯৮ সালের একটি রচনায় সেন তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে নাট্যকার বার্নার্ড শ-এর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ নাটকটির একটি দৃশ্যের সবিস্তার উল্লেখ করেছিলেন। সেখানে আইরিশ-আমেরিকান একটি চরিত্র মেলোন এবং তার পুত্রবধূ ভায়োলেট-এর মধ্যে কথা হচ্ছে ১৮৪৭ সালের আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। কথাগুলো লক্ষ্য করার মতো।

‘মেলোন :আমার বাবা সেই কালো সাতচল্লিশের ক্ষুধার জ্বালায় মারা গিয়েছিলেন। হয়তো তুমি এর আগে এ নিয়ে শুনে থাকবে।

ভায়োলেট :সেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন?

মেলোন :না, আমি ক্ষুধার কথা বলছি। যখন কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে এবং সে দেশ থেকে খাদ্যের রফতানি চলতে থাকে, তখন কোনো দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমার বাবা ক্ষুধার কষ্টে মারা গেছেন, আর আমি ক্ষুধার কষ্টে আমার মায়ের হাত ধরে আমেরিকায় চলে এসেছি।’

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটাকে বড় করে দেখার উপায় নেই। ক্ষুধার কষ্ট এক পর্যায়ে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী আকার ধারণ করলে তা দুর্ভিক্ষের রূপ নিতে পারে। অমর্ত্য সেন তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। মেলোন সাহেব যেটা ভেবেছেন সেটা ভুল। খাদ্য সরবরাহে ঘাটতিকেন্দ্রিক চিন্তা দিয়ে দুর্ভিক্ষের প্রকৃতিকে ঠিক বোঝা যাবে না।

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ড শ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কথা এখানে আমরা টেনে আনতে পারি, যার প্রতিফলন ঘটেছিল সাহিত্য ও সংবাদপত্রে। সাহিত্যের এসব বিবরণী থেকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে এক বিশ্বস্ত চিত্র উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে :(ক) ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষ বা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত; (খ) ১৮৭০ দশকের খাদ্যাভাব বা গণমানুষের মধ্যে ক্ষুধার বিস্মৃতি; (গ) ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত); (ঘ) ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ (যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মন্বন্তর শুধু ঔপনিবেশিক পটভূমিতেই সংঘটিত হয়নি। উপনিবেশ-উত্তর ‘আধুনিক’ যুগেও একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হিসেবে এটি থেকে গেছে; এবং (ঙ) ২০০৭-০৮ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আকস্মিক খাদ্য ঘাটতি ও চালের মূল্য বৃদ্ধি (যার ফল-পরিণামে সামরিক বাহিনী চালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনসমর্থনের ভিত প্রবলভাবে নড়ে গিয়েছিল এবং নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে পড়তে রাজশক্তি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল)। অবশ্যই এসব ‘এপিসোড’-এ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রকৃতি এক রূপ নয় এবং এদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বা কনটেক্সটও ভিন্ন। তবে প্রকৃতি ও প্রেক্ষিতের ভিন্নতা আমাদের অভিনিবেশের মূল বিষয়বস্তু নয়। এসব ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে, কীভাবে সাহিত্যের পাতায় সেসব বিবরণী উঠে এসেছে এবং এর থেকে সেদিনের অর্থনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে কিছু বিরল উন্মোচন হতে দেখি, যার সঙ্গে আর্কাইভে দলিলপত্র এবং সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের সাক্ষ্যও সময় সময় নিষ্প্রভ ঠেকে।

৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

বাংলা সন ১১৭৬-এর (বা ইংরেজি ১৭৭০ সাল) মন্বন্তরের কারণে বাংলাদেশ ‘শ্মশানে’ পরিণত হয়। আমি সন্দেহ করি, এই ‘শ্মশান’ শব্দটির পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবহারের পেছনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা রয়ে গেছে গোচরে-অগোচরে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিমালা অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ প্রকাশিত হয় এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। এই স্লোগানে বর্ণিত ‘শ্মশান’ হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরেই প্রথম। এই দুর্ভিক্ষের একশ’ বছর পরে উইলিয়াম হান্টারের ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ (১৮৬৮) থেকে জানা যায় :১৭৭০ সালের মে মাসের পূর্বেই বাংলার ‘এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’ হান্টারের এই বিবরণীটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের মূল তথ্যভিত্তি জুগিয়েছিল। সম্প্রদায়গত বিভেদবাদী চিন্তার জন্য ‘আনন্দমঠ’ দুর্নাম কুড়িয়েছিল সঙ্গত কারণেই। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে জানার জন্য এবং সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক পটভূমি বোঝার জন্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসকে আজও পাঠ করা যেতে পারে।

কীভাবে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো বাংলায়, বঙ্কিম তার বিবরণ পেশ করছেন এভাবে- আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদেই। উদ্ৃব্দতিটি দীর্ঘ। কিন্তু দুর্ভিক্ষের ঘটনা-পরম্পরার কার্য-কারণ সূত্র বোঝার জন্য তা বিশেষ সহায়ক :

‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্ফ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃণ্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।’

শুধু স্বল্প-বিত্ত জনগোষ্ঠী নয়, অনেক বিত্তবান পরিবারও ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। বঙ্কিমের লেখায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় :’এক বৃহৎ অট্টালিকা- তাহার বড় বড় ছড়ওয়ালা থাম দূর হইতে দেখা যায়- সেই গৃহারণ্যমধ্যে শৈলশিখরবৎ শোভা পাইতেছিল। … তাহার অভ্যন্তরে ঘরের ভিতর মধ্যাহ্নে অন্ধকার। অন্ধকারে নিশীথফুল্লকুসুমযুগলবৎ এক দম্পতি বসিয়া ভাবিতেছে। তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।’

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে ‘কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচিত হয়নি’- এ রকম মন্তব্য করেছেন সুব্রত রায়চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’। যেটুকু বিবরণ পাই তা হান্টার সাহেবের লেখা থেকে। ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (খরা/অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি) কারণে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। হান্টার লিখেছেন, ‘The famine of 1770 was therefore a one year’s famine, caused by the general failure of the December harverst in 1769, and intensified by a partial failure of the crops of the previous year and the following spring’. এই ঘটনার আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষক-অর্থনীতিতে প্রবল ধস নেমে আসার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। হান্টার আরও জানিয়েছেন যে, দুর্ভিক্ষের পরের বছর প্রকৃতি মুখ তুলে তাকালেন। বর্ষা হয়ে মাটি আবারও উর্বর হওয়ার সুযোগ পেল। কিন্তু মানুষের দুর্গতি গেল না। কেননা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস পর্যন্ত উপলব্ধি করলেন যে, চাষাবাদ করার মতো যথেষ্ট লোকবল বাংলায় আর অবশিষ্ট নেই। হান্টারের গণনামতে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ‘কৃষকদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের’ প্রাণহানি হয়েছিল। শহর এলাকার ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের পাশাপাশি গ্রাম-এলাকার ডি-পপুলেশনের অভিঘাত এসে পড়েছিল বাংলাদেশে। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট মোগল সম্রাট শাহ-আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ‘দেওয়ানি’ লাভ করার অধিকার পায়। দেওয়ানি অর্থাৎ খাজনার টাকা আদায় করার অধিকার লাভ। যেটা লক্ষণীয়, দেওয়ানি লাভ করার পাঁচ বছরের মাথাতেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো এক অদৃষ্টপূর্ব সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ বাংলায় নেমে আসে। এতে ইংরেজ শাসকবর্গের সুশাসনের গুণাবলির পরিচয় পাওয়া যায় না। যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়, সে দেশে রাজ্য শাসনের নৈতিক অধিকার থাকে না- সে কথা বঙ্কিম জানতেন। সেটা ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি আনন্দমঠ লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন- এমনটা ভাবাও অবাস্তব নয়। মুখে যদিও তিন বলেছেন, ‘ইংরেজকে রাজা করিব’। কিন্তু আমার ধারণা, তার উদ্দেশ্য অন্তর্ঘাতমূলক। তিনি আসলে দেখাতে চান, কোম্পানির হাতে শাসনভার চলে যাওয়ার কারণেই ছিয়াত্তরের মতো এত বড় মন্বন্তর হতে পেরেছিল। ১৭০০ থেকে ১৭৬৫ পর্যন্ত নবাবি আমলে কৃষি ব্যবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতির চিহ্ন পরিলক্ষ্য হলেও সে সময়ে বাংলায় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। তখন চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ ছিল; সময় সময় বাংলাদেশ উপোসী থাকত, কিন্তু মন্বন্তর ছিল না। হান্টারের বর্ণনা অনুসরণ করেই তিনি ইংরেজ শাসনকে পরোক্ষে সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘১১৭৪ সালে ফসল ভালো হয় নাই। সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ্য হইল- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল… অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।’

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, বঙ্কিমের বর্ণনায় শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ছিল না। সাধারণ মানুষ যখন উপবাসে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজশক্তি (প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসন) ‘রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায়’ বুঝে নিচ্ছে; যখন অনাবৃষ্টিতে সামান্যই ফলন হয়েছে, তখন রাজশক্তি সিপাহিদের তথা সামরিক বাহিনীর জন্য সেই ফসল কিনে রাখছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে; এমনকি যখন লোকজন দুই বেলা করে উপবাস করছে, তখনও ‘রাজস্ব আদায়’ বন্ধ হয়নি। যাতে কোম্পানির মোট রাজস্ব আদায়ে টান না পড়ে তাই উপবাসের বছরে রাজস্বের মাত্রা ‘শতকরা দশ টাকা’ হারে বৃদ্ধি করা হলো। স্পষ্টতই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও অপশাসনের ওপরে, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত দুঃখভোগকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা প্রথমত।

দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের বছরে অন্যায় রাজস্ব-আদায়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছাড়াও বঙ্কিম দুর্ভিক্ষের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের ছায়াসঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সেটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গ। বঙ্কিম লিখছেন :

‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সমর পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত :বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s