বিনায়ক সেন
১. সভ্যতার সংঘাত
বার্লিন দেয়াল পতনের দু’বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হলো স্যামুয়েল হান্টিংটনের নাটকীয় থিসিস_ ‘সভ্যতার সংঘাত’। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থি রক্ষণশীলদের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক। সেখানেই হান্টিংটন এ বক্তৃতাটি দিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে প্রভাবশালী ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সাময়িকীতে থিসিসটি আরও সুসংগঠিতভাবে প্রকাশ পেল। সেখানে তিনি যা লিখলেন তা অনুবাদে দাঁড়ায় মোটামুটি এ রকম :’আজকের পৃথিবীর সমস্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মৌলিক উৎস এবার থেকে আর ভাবাদর্শ বা অর্থনৈতিক কার্যকারণের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রধান উৎস হবে সাংস্কৃতিক। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া জাতি-রাষ্ট্রসমূহ এবার থেকে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণেই পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। সভ্যতার সংঘাত এবার থেকে বিশ্বরাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হয়ে দেখা দেবে। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যেকার বিভেদরেখা ধরেই আগামী দিনের যুদ্ধের রেখা নির্মিত হবে।’ ‘বিভিন্ন সভ্যতা’ মানে পাশ্চাত্য (পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা) সভ্যতার সাথে অন্যসব সভ্যতার লড়াই। তবে নন-ওয়েস্টার্ন সভ্যতাসমূহের মধ্যে হান্টিংটন বিশেষ করে চিহ্নিত করেছিলেন ইসলাম প্রভাবিত সভ্যতা বা মুসলিম সভ্যতাকে। ভারত ও রাশিয়াকে ফেললেন ‘সুইং সভ্যতা’র কাতারে, অর্থাৎ একপ্রকার দোদুল্যমান মিত্র হিসেবে। ‘আমরা এবং তারা’_ এই লড়াই কার্যত দাঁড়িয়ে গেল পাশ্চাত্য বনাম ইসলামী সভ্যতার লড়াইয়ে। হান্টিংটনের বইয়ের পূর্ণ শিরোনাম ছিল ‘সভ্যতার সংঘাত এবং বিশ্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস’। সভ্যতার সংঘাত_ এই শব্দবন্ধটি অবশ্য তার আগেই ব্যবহৃত হয়েছে ১৯২৬ সালের একটি বইয়ে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বেসিল ম্যাথিউস লিখেছেন অনুসন্ধানী গ্রন্থ :’ইয়াং ইসলাম অন ট্রেক :স্টাডি ইন দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস্’। এ বই প্রকাশের ৬ বছর পরে ১৯৩২ সালে পারস্যে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। মূলত ইরান এবং অংশত ইরাক ভ্রমণের বিবরণী নিয়ে লেখা হবে ‘পারস্য যাত্রী’। উপমহাদেশের বাইরে এটাই হবে তার শেষ বিদেশ ভ্রমণ। তবে নিছক ভ্রমণ কাহিনী ছিল না বইটি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, বিশেষত মুসলিম সভ্যতার সাথে ঘনিয়ে ওঠা সংঘাত-তত্ত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ দেখা যাচ্ছে অবহিত ছিলেন। এ নিয়ে বইয়ের নানা স্থানে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে, যার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণ ও সমকালীন গুরুত্ব কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এ নিয়েই কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছি এখানে।
২. আকাশ-সাম্রাজ্যবাদ
‘দূরত্ব’ তৈরি করতে পারলে অন্যপক্ষকে শত্রুপক্ষ ভাবা সহজ এবং সেই শত্রুর বিনাশ সাধনও অনায়াসসাধ্য হয়ে ওঠে। সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্বের মূলে রয়েছে নানা সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে অপরিচিতের দেয়াল তুলে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা। বিভিন্ন গোত্র, জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে অচেনা দেয়াল তুলে বৈরী ভাবনা সৃষ্টির প্রয়াসের বিরুদ্ধে কোরআন শরীফে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে :’আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।’ অপরিচিতকে সহজেই হত্যা করা যায় এবং এ কাজে প্রযুক্তিগত উন্নতি বাড়তি উৎসাহ যোগাতে পারে। এখানে ‘দূরত্ব’ বলতে শুধু ভৌগোলিক দূরত্বকে বোঝানো হচ্ছে না; মানস ভূগোলের ব্যবধানকেও নির্দেশ করা হচ্ছে। জাতিতে জাতিতে ‘দূরত্ব’ সৃষ্টি করার জন্য চাই নয়া ধারাভাষ্য, নতুন জ্ঞান-উৎপাদন; যার মাধ্যমে আপনকে পর, পরকে শত্রু এবং শত্রুকে দূর থেকে অধুনাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই নির্মূল করা সম্ভব। দূরত্ব-সৃষ্টির মাধ্যমে ‘অপরায়ন’ (মানে পর করে দেওয়ার) রাজনীতি ও এর আধুনিক কলাকৌশল রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়েছিল। তখন সবেমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী ভাগবাটোয়ারা শেষ হয়েছে, যদিও খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চলছে বিভিন্ন অঞ্চলেই। এই পরিস্থিতিতেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন (দীর্ঘ উদৃব্দতি কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি):
“বোগদাদে ব্রিটিশদের আকাশফৌজ আছে। সেই ফৌজের খ্রিস্টান ধর্মযাজক আমাকে খবর দিলেন, এখানকার কোন শেখদের গ্রামে তারা প্রতিদিন বোমাবর্ষণ করছেন। সেখানে আবালবৃদ্ধবনিতা যারা মরছে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঊর্ধ্বলোক থেকে মার খাচ্ছে; এই সাম্রাজ্যনীতি ব্যক্তিবিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট করে দেয় বলেই তাদের মারা এত সহজ। খ্রিস্ট এসব মানুষকেও পিতার সন্তান বলে স্বীকার করেছেন, কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযাজকের কাছে সেই পিতা এবং তার সন্তান হয়েছে অবাস্তব; তাদের সাম্রাজ্য-তত্ত্বের উড়োজাহাজ থেকে চেনা গেল না তাদের; সেজন্য সাম্রাজ্যজুড়ে আজ মার পড়ছে সেই খ্রিস্টেরই বুকে। তাছাড়া উড়োজাহাজ থেকে এসব মরুচারীকে মারা যায় এতটা সহজে, ফিরে মার খাওয়ার আশঙ্কা এতই কম যে, মারের বাস্তবতা তাতেও ক্ষীণ হয়ে আসে। যাদের অতি নিরাপদে মারা সম্ভব, মারওয়ালাদের কাছে তারা যথেষ্ট প্রতীয়মান নয়। এই কারণে, পাশ্চাত্য হননবিদ্যা যারা জানে না, তাদের মানবসত্তা আজ পশ্চিমের অস্ত্রীদের কাছে ক্রমশই অত্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে।”
আকাশের দূরত্ব থেকে দেখলে নিচের মানুষের অস্তিত্ব মানবেতর পর্যায়ে চলে যায়, আর সে অবস্থায় প্রযুক্তি সহায়ক হলে মানব-হত্যায় আত্মার সন্তাপ হয় আরও কম। বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ-বর্ণিত বাগদাদে আমরা দেখিনি কি আকাশ থেকে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ বা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফগানিস্তানে উপর্যুপরি ‘ড্রোন আক্রমণ?’ সরাসরি নৈকট্যে কমান্ডো সৈন্য পাঠিয়ে গুলিবর্ষণের চেয়ে অন্তরীক্ষে থেকে মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় রিমোট চালিত বিমান (ড্রোন) আক্রমণ অনেক বেশি ‘বিবেকসম্মত পন্থা’ বলে পাশ্চাত্যে বিবেচিত হয়েছে! একেই লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্ব নির্মিত উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে।’ সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্ব এ রকমই একটি আক্রমণাত্মক-তত্ত্ব নির্মিত উড়োজাহাজ যা বুশ, সাদ্দাম, ব্লেয়ার, লাদেন সবাইকেই একযোগে ককপিটে বহন করতে সক্ষম। দাঙ্গা বাধানোয় কুশলী শ্যারন বা হালের মোদিও এর থেকে বাদ যাবেন না। সমস্যা জট পাকিয়েছে শুধু পাশ্চাত্যের মনের গভীরে নয়, সংকট দেখা দিয়েছে প্রাচ্যেও। এ যুগে নৈর্ব্যক্তিক মনন মানবতাবিদ্ধ না হলে হয়ে উঠতে পারে আবেগ-অনুভূতিহীন মারের যন্ত্র_ আ কিলিং মেশিন।
গীতায় অর্জুন যে আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে বন্ধু-স্বজনদের ওপরে অস্ত্রাঘাতে শেষ পর্যন্ত বিব্রত হলেন না, অর্জুন-বিষাদ যে এত ক্ষণস্থায়ী হলো, এর পেছনেও রয়েছে সাম্রাজ্য-বিস্তারের অমোঘ যুক্তি। তার মানে বিষয়টা শুধু পাশ্চাত্যের লোভের আগ্রাসনের নয়, সমস্যাটা প্রাচ্য-মনেরও। অর্জুন দক্ষ তীরন্দাজ। যোজন যোজন দূরত্বে থেকে নিষ্কাম মানসলোকে ডুবে গিয়ে সে যখন ‘শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরোয়, তখন সে নির্মমভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না। কেননা হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আঁধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়োজাহাজ-অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর।’ দেখা যাচ্ছে, পাশ্চাত্যের নিরাবেগ যুক্তির দর্শন ও প্রাচ্যের নিরাবেগ মোহমুক্তির দর্শন মিলতে পারে। মিলছে একই মারের বিন্দুতে_ একই ক্ষমতা প্রয়োগের ভরকেন্দ্রে। ‘সেখান থেকে যাদের ওপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য’ বুঝি এই যে_ শরীরের মৃত্যু হয়, কিন্তু আত্মার মৃত্যু হয় না! এভাবেই নিঃসহায়রা যুগে যুগে পড়ে পড়ে মার খেয়েছে। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দর্শনের এক অন্ধকার দিকের এই রবীন্দ্র-কৃত ব্যাখ্যা আমাদের চেতনাকে সচকিত করে দেয়। ‘সেন্টিমেন্টের বালাই নেই’ এমন আধুনিক যুগকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্কতার নামে বরণ করতে রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। নবযুগের পুষ্পক-রথ, দিব্যাস্ত্র বা গাণ্ডীবের টংকার কোন দেবত্বকে ইঙ্গিত করে না। ‘জাভাযাত্রীর পত্রে’ তাই তিনি নিদ্বর্িধায় লিখতে পেরেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে মানুষ যদি একেবারে মরে, তবে সে এই জন্যেই মরবে_ সে সত্যকে জেনেছিল কিন্তু সত্যের ব্যবহার জানেনি। সে দেবতার শক্তি পেয়েছিল, দেবত্ব পায়নি।’ ‘পারস্য যাত্রী’তে এ নিয়ে পাশ্চাত্যকে দুষেছেন এই বলে যে, ‘য়ুরোপ দেবতার অস্ত্র পেয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে দেবতার চিত্ত পায়নি।’ অন্যদিকে প্রাচ্য এত ধর্মাশ্রিত ধর্ম নিয়ে কথা বললেই গায়ে ফোস্কা’ পড়ে যায়, তবু ধর্মের স্থৈর্য্য ও ধৈর্য তার অর্জন হয় নি।
৩. হাফেজ-সাদির দেশে
গর্বাচভের চরিত্রে একটি বড় ত্রুটি ছিল রাজনৈতিক দ্বিধা ও সংশয়ের ভেতরে বিরামহীনভাবে ভুগতে থাকা। তাঁর অনিচ্ছুক পৌরোহিত্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। কিন্তু সব পতন-স্খলনের মধ্যে একটি সত্য-উপলব্ধি ছিল তাঁর। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সত্যের ওপরে মার্কসবাদীদের একচেটিয়া অধিকার নেই এবং কোনো ভাবাদর্শই মানবকল্যাণের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আগুনের, পরে যেমন মানুষের সভ্যতা-নিরপেক্ষভাবে অধিকার রয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপরে যেমন রয়েছে, বাজার-ব্যবস্থার, পরেও তেমনভাবেই স্বাভাবিক দাবি রয়েছে। মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে আগুন আবিষ্কারের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল পণ্য-বিনিময় ব্যবস্থা তথা পণ্য-অর্থনীতির আবিষ্কার। সমাজতন্ত্রের অর্থনীতিতেও নিতান্ত ভাবাদর্শ-তাড়িতভাবে অন্ধ না হলে এই পণ্য-অর্থনীতির সর্বাধুনিক ব্যবহার হতে পারত। পারস্যে আসার ঠিক দু’বছর আগে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, মানুষের স্বভাবের সঙ্গে সহজেই মেলে এমন রীতিনীতির সঙ্গে আপোসরফা করা প্রয়োজন। কিছু কিছু প্রগতির ধারণা জন্মায় হয়তো কোনো বিশেষ দেশ বা ভূগোলে, কিন্তু তাতে সহজাত অধিকারবোধ করে সব দেশের ও সভ্যতার মানুষই। অক্টোবর বিপ্লবের বৈষম্য-বিরোধী ধারণাও তেমনি। বিপ্লবের এত বছর পরেও ‘বৈষম্যকে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না’ এই ধারণার মৃত্যু হয়নি। রাশিয়ায় গিয়ে এই ধারণার প্রতি যেমন আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পারস্যে গিয়ে তেমনি মরমীবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। হাফিজ-সাদী বা রুমীর কবিতার প্রতি যেমন। পারস্যের এই মরমি কবিদের মধ্য দিয়ে ইসলামি সভ্যতার যে পরিচয় মেলে তা চিরকালের অনুভূতি; সব ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষের কাছেই তা আদরণীয় সঞ্চয়। ঠিক এই যুক্তিতেই ইউরোপের চেয়ে পারস্যেই তাঁকে ভালো বুঝতে পারবে এ কথা কবি বিশ্বাস করতেন : ‘কাব্য পারসিকদের নেশা, কবিদের সঙ্গে এদের আন্তরিক মৈত্রী। আমার খ্যাতির সাহায্যে সেই মৈত্রী আমি কোনো দান না দিয়েই পেয়েছি। অন্য দেশে সাহিত্যরসিক মহলেই সাহিত্যিকদের আদর, পলিটিশিয়ানদের দরবারে তার আসন পড়ে না। এখানে সেই গণ্ডি দেখা গেল না। যাঁরা সম্মানের আয়োজন করেছেন তারা প্রধানত রাজদরবারিদের দল। মনে পড়ল ঈজিপ্টের কথা। সেখানে যখন গেলেম রাষ্টনেতারা আমাদের অভ্যর্থনার জন্যে এলেন। বললেন, এই উপলক্ষে তাদের পার্লামেন্টের সভা কিছুক্ষণের জন্যে মুলতবি রাখতে হলো। প্রাচ্যজাতীয়ের মধ্যেই এটা সম্ভব। এদের কাছে আমি শুধু কবি নই, আমি প্রাচ্য কবি। সেই জন্যে এরা অগ্রসর হয়ে আমাকে সম্মান করতে স্বভাবত ইচ্ছা করেছে, কেননা সেই সম্মানের ভাগ এদের সকলেরই।’
নোবেলপ্রাপ্তির পর সেলিব্রেটির প্রতি আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই আগ্রহবোধের মধ্যে আত্মীয়তাবোধের প্রকাশ দেখেছেন। ‘ইন্দো-এরিয়ান’ সূত্রে পারস্যের সঙ্গে তার ‘রক্তের সম্পর্ক’ রয়েছে এ কথা অনুমানের পর আসল কথাটা পাড়লেন : ‘এখানে একটা জনশ্রুতি রটেছে যে, পারসিক মরমিয়া কবিদের রচনার সঙ্গে আমার লেখার আছে স্বাজাত্য। … বিনা বাধায় এদের কাছে আসা সহজ, সেটা স্পষ্ট অনুভব করা গেল। এরা যে অন্য সমাজের, অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের, অন্য সমাজগণ্ডির, সেটা আমাকে মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো উপলব্ধি আমার গোচর হয়নি।’ মরমিয়া কবি বা সুফী-সাধকের সঙ্গে নিজের মিলের প্রসঙ্গ পারস্যে এসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম আবিষ্কার করলেন এমনটা নয়। তিনি নিজেকে সুফী-সাধক কবিদের কাছের লোক বলেই ভেবেছেন বহুকাল থেকে। পারস্যে উষ্ণ অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি তাঁর ‘সুফী’ পরিচয়টাকেই বিশেষ করে তুলে ধরেছিলেন : ‘আপনাদের পূর্বতন সুফী-সাধক কবি ও রূপকার যাঁরা আমি তাঁদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষা নিয়ে; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না।’ বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনর্গল ফার্সি জানতেন। কবির নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ‘আমার পিতা ছিলেন হাফেজের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর মুখ থেকে হাফেজের কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেই কবিতার মাধুর্য দিয়ে পারস্যের হৃদয় আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘অবশেষে হাফেজের সমাধি দেখতে বেরোলুম, পিতার তীর্থস্থানে আমার মানস অর্ঘ্য নিবেদন করতে।’ দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার মতো ভিন্নতর অর্থে পারস্যও তাঁর কাছে সভ্যতার এক ‘তীর্থস্থান’ বলে মনে হয়েছিল। সেটা শুধু আচার্য পিতৃদেবের স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ নিবেদনের সুবাদে তাঁর নে এসেছিল এরকম ভাষার কোন কারণ নেই। এর প্রধান কারণ ছেলেন তিনি নিজেই। পারস্য-যাত্রার বহু আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের ভেতরে মধ্যপ্রাচ্য, ইসলাম ও মরমীবাদের প্রতি আগ্রহ দেখে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত আকর্ষণ থেকেই তিনি সুফীবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন তখন সুফীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কোন ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল না। রামমোহন স্বয়ং ব্রাক্ষ্ম মতের প্রচারে খ্রিস্টীয় ইউনিটেরিয়াল চার্চ-এর পাশাপাশি কোরআন ও ইসলাম থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন। মুতাজেল্লা সম্প্রদায়ের যুক্তিবাদী ধরো তাঁকে বাড়তি উৎসাহ দিয়েছিল।
কিন্তু এরকম সে আমলে অনেকেই ছিলেন। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ‘কালচারের লড়াই’ (১৯৩০) বলে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী বিদ্যাবিনোদ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন-চরিত থেকে একটি উদ্ধৃতি দেন।তাতে লেখা : ‘ফির্দ্দোসি, সাদি, ওমর খৈয়াম, জামি, জালাল উদ্দিন রুমী প্রভৃতি পারস্যের বাণীপুত্রগণও তাঁহার সথা ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র বাহ্যিক আচারে হিন্দু হইলেও অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে তিনি ভক্ত সুফী হইয়া উঠিয়াছিলেন।
দুই পক্ষেই এটা ঘটেছিল। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘পারস্য প্রতিভা’ গ্রন্থে মুক্তবুদ্ধির চিন্তাবিদ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ ইসলামী ধারায় সুফীমতের গুরুত্ব বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। তিনি এ-ও দেখিয়েছিলেন যে কোরআনের শিক্ষার সাথে উপনিষদের ব্রক্ষ্মসূত্রের ‘সুন্দর ঐক্য’ রয়েছে : ‘বেদান্তের সহিত সুফীমতের প্রধান সাদৃশ্য _ এ উভয়ই শুধু একেশ্বরবাদ নহে অধিকন্তু উভয়ের চৈতন্যে বিশ্বাসী অদ্বৈতবাদ।’ পারস্যে যাত্রার আগে ‘পারস্য প্রতিভা’ বইটি রবীন্দ্রনাথের হাতে পেঁৗছেছিল কিনা জানি না, তবে সন্দেহ নেই। অবশ্য বরকতুল্লাহ্র যুক্তির সাথে পরবর্তী সময়ে আহমদ শরীফের বিশ্লেষণে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে পারস্যের সুফীমতকে দ্বৈতবাদীদের দলে ফেলেছেন : ‘কুফায়াকুল’ দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে ‘একোহম বহুস্যাম’ অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সুফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী, কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে অদ্বৈত সত্ত্বার প্রয়াসে। সুফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরনের কাঙালি।… সুফীমতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যান্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল।’ আমাদের পক্ষে এসব গূঢ় তত্ত্বালাপের মর্মার্থ বোঝা সহজ নয়। কিন্তু যেটা লক্ষ্য করার_ তা হলো বিভিন্ন ধর্মের ও দর্শনের মধ্যে ‘সংঘাত যতটা, মিলের বা দেওয়া-নেওয়ার প্রবণতাও ইতিহাসে ততটা কম নয়। এই ‘মিলের ইতিহাস’ লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পারস্যবাসী মরমী বন্ধুদের পাশাপাশি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সুফীতত্ত্বের স্থানীয় বিকাশের প্রসঙ্গ চলে আসবে। হাফেজকে যে বাংলার শাসক একবার বেড়িয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন, তা এমনি এমনি নয়_ তার পেছনে সভ্যতার সংলাপের সাংস্কৃতিক তাগিদও কাজ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের একাধিক বক্তৃতায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই তাগিদ থেকেই। ১৯১৫ সালে মুসলমান ঘরে জন্ম নেওয়া কিন্তু সন্ত রামানন্দের শিষ্য কবীরের কবিতার ইংরেজি তর্জমা প্রকাশের উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ। এর আগে ও পরে আর কেউই কবীরের কবিতা অনুবাদে প্রবৃত্ত হননি বস্তুত। বেদান্ত, সুফীবাদ বৈষ্ণব ও বাউল ভাবের দর্শনের সাথে কবির একান্ত ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার একটি অলিখিত ইতিহাস রয়ে গেছে আজ অবধি। অন্ধ অনুসরণের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি অনীহা থেকেই রবীন্দ্রনাথ এটা করেছিলেন। কবীরের ইংরেজি তর্জমার ভূমিকায় কবীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক এভলিন আন্ডারহিল লক্ষ্য করেন যে, কবীরের গানে পারস্য মরমী কবিদের (আত্তার, সাদি, রুমি, হাফেজ) গভীর প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন ধারার ও ধর্মের মরমী দর্শনের মধ্যে অনায়াস যাতায়াত ছিল কবীরের। এভলিনের একথাটি রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রেও খাটে। তাঁর ‘মনের মানুষ’-এর ধারণাটি কোন বিশেষ ধর্মের বা ঘরানার মধ্যে পড়ে না। এর মধ্যে নানা ধর্মের মরমীবাদের ছায়ামতি ঘটেছে যেমন, নিজস্ব ধর্ম নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী চিন্তারও প্রভাব পাই। কিন্তু তা ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে নিজস্ব একান্ত মরমী ভাবাদর্শকে তিনি কখনো প্রয়োগ করতে চাননি। জানতেন, এতে করে মরমী দর্শন ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা কোনো অংশেরই কল্যাণ সাধন হবে না। মরমীবাদে ব্যক্তিজীবনে ধ্যানকেন্দ্রী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাকে রেখেছিলেন নিরঙ্কুশ ধর্মনিরপেক্ষতায়_ ইহজাগতিকতার চৌহদ্দিতেই। যখন সুফী-সাধক বলে নিজেকে পরিচিত করাচ্ছেন তখনও পারস্যের বিদ্বৎ সমাজকে জানাতে ভোলেননি যে, তিনি ইউরোপের আধুনিকতারও সমঝদার। ইউরোপের যা সভ্যতা তা গ্রহণ করতে হবে।
৪. অন্ধ ধর্মাচারের বোঝা
সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্বের বয়ান করে হান্টিংটন নবপর্যায়ে পাশ্চাত্যের কূটনীতির মূল অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র। কিন্তু সংঘাত-তত্ত্বের দায়দায়িত্ব প্রাচ্যও এড়াতে পারে না। অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের ও মিথ্যে ধর্মাচারের দৌরাত্ম্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা লেখায়, প্রবন্ধে ও চিঠিপত্রে আক্ষেপ করেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস ক্রমশ একটি খাদের দিকে গড়িয়ে চলছিল, এ কথা তিনি জানতেন। ধর্ম-বিভক্ত সমাজে কী করে সত্যিকারের ধর্মবোধ জাগ্রত হতে পারে সার্বিক মানবকল্যাণকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে এর জন্য তিনি দেশে-বিদেশে শুভ দৃষ্টান্ত খুঁজে বেড়াতেন। তুরস্কের কামাল আতার্তুক মোল্লাতন্ত্রকে বশে এনেছেন বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “কামাল পাশা বললেন মধ্যযুগের অচলায়তন থেকে তুরস্ককে মুক্তি নিতে হবে। তুরস্কের বিচার বিভাগের মন্ত্রী বললেন : মেডিয়াভেল প্রিন্সিপলস্ মাস্ট গিভ ওয়ে টু সেক্যুলার ল’স। উই আর ক্রিয়েটিং আ মডার্ন, সিভিলাইজড্ নেশন।” মধ্যযুগের শাসন থেকে তুরস্ককে বেরিয়ে আসতে হবে, কেননা ‘পরিপূর্ণভাবে বুদ্ধিসঙ্গতভাবে প্রাণযাত্রা নির্বাহে বাধা দেয় মধ্যযুগের পৌরাণিক অন্ধ সংস্কার’। এর জন্য প্রয়োজনে যেন কিছুটা বল প্রয়োগেও কবি প্রস্তুত : ‘আধুনিক লোক ব্যবহারে’ মধ্যযুগের অন্ধ সংস্কারের প্রতি ‘নির্মম হতে হবে’ এই ছিল কামাল পাশার অনুসারীদের ঘোষণা। অন্যদিকে ইরানের রেজা শাহ ছিলেন কসাক সৈন্য দলের অধিপতি মাত্র, বিদ্যালয়ে ‘য়ুরোপের শিক্ষা তিনি পাননি’, এমনকি ‘পারসিক ভাষাতেও তিনি কাঁচা’। এসব বলার পর প্রশস্তির সুরে বললেন, ‘আমার মনে পড়ল আমাদের আকবর বাদশাহের কথা। কেবল যে বিদেশির কবল থেকে তিনি পারস্যকে বাঁচিয়েছেন তা নয়, মোল্লাদের আধিপত্য জালে দৃঢ়বদ্ধ পারস্যকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্রকে প্রবল ও অচল বাধা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক, রেজা শাহ্র ইরান তার পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে তা বেশ বোঝা যায়।
আর উপমহাদেশ? হাফেজের সমাধি যেখানে সেখানকার গভর্নরকে কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জটিল ধর্মের পাকে আপাদমস্তক জড়িভূত’ যে ভারতবর্ষ তার মুক্তি আসবে কীভাবে? উত্তরে গভর্নর বললেন, ‘সাম্প্রদায়িক ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে যতদিন না ভারত একাত্ম হবে’ ততদিন এই সমাজের নিষ্কৃতি নেই। রবীন্দ্রনাথ তারপর আক্ষেপ করে বলছেন, ‘অন্ধ আচারের বোঝার তলে পঙ্গু আমাদের দেশ, বিধিনিষেধের নিরর্থকতায় শতধাবিভক্ত আমাদের সমাজ।’ হাফেজের সমাধিতে যখন গেছেন, দেখলেন সমাধিরক্ষক একখানি বড় চৌকো আকারের বই এনে উপস্থিত করল। সেটা ছিল হাফেজেরই একটি কাব্যগ্রন্থ। এ সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে, কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুঝে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতাটি বেরোবে তার থেকেই বোঝা যাবে সে ইচ্ছাটি সফল হবে কিনা। রবীন্দ্রনাথ সে বইয়ের পাতা খোলার আগে চোখ বুজে মনে মনে ইচ্ছা করলেন, ‘ধর্ম নামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়।’ এর বছর পনেরোর মধ্যেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও দেশান্তরের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারতবর্ষ’। হিন্দু ও মুসলমান এ দুই সম্প্রদায় নিয়ে এক ‘মহাজাতি’ গঠনের স্বপ্ন ছিল তাঁর। ১৯৪৭-এর দেশভাগ সে ক্ষেত্রে তাঁর স্বপ্নের বিপরীতে হলেও হয়তো তারপরও পুরোপুরি হতোদ্যম হতেন না তিনি। ঘরের বিবাদ অহর্নিশি চলার চেয়ে ঘর ভাগ হওয়াই ভালো।
‘পারস্য যাত্রী’র একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে এশিয়ার নবজাগরণের বা রেনেসাঁর কথা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এশিয়া জাগছে এবং প্রতিটি দেশেই এই জাগরণপর্ব চলছে যার যার মতো করে। রবীন্দ্রনাথ কায়মানোবাক্যে চেয়েছেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার পাশাপাশি প্রাচ্যও উঠে দাঁড়াক : ‘এ কথা বলা বাহুল্য যে, এশিয়ার প্রত্যেক দেশ আপন শক্তি প্রকৃতি ও প্রয়োজন অনুসারে আপন ঐতিহাসিক সমস্যা স্বয়ং সমাধান করবে… তাই আমি এই কামনা ঘোষণা করি যে, আমাদের মধ্যে সাধনার মিলন ঘটুক। এবং সেই মিলনে প্রাচ্য মহাদেশ মহতী শক্তিতে জেগে উঠুক_ তার সাহিত্য, তার কলা, তার নূতন নিরাময় সমাজনীতি, তার অন্ধসংস্কারমুক্ত বিশুদ্ধ ধর্মবুদ্ধি, তার আত্মশক্তিতে অবসাদহীন শ্রদ্ধা’ নিয়ে। এশিয়ার এই নবজাগরণের তালিকার মধ্যে যেমন ছিল দূরপ্রাচ্যের জাপান ও চীন, তেমনি ছিল নিকট মধ্যপ্রাচ্য। পশ্চিম এশিয়ার নব-আন্দোলিত মুসলমান সমাজের এক বড় ধরনের উত্থানের প্রতীক্ষা করছিলেন কবি। তিনি জানতেন মিসর, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান প্রভৃতি দেশের প্রাগ্-ইসলামি ঐতিহ্য এবং ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগের বিবরণী। আব্বাসীয় আমলের সুশাসন, বিজ্ঞান-সাধনা ও শিল্পকলা তাঁকে বিমোহিত করেছিল। বা তারও আগের সম্রাট দরিয়ুসের রেখে যাওয়া ভগ্নাবশেষের সাথে মোয়েনজো দারেরি সমসাময়িক সভ্যতার মিল খুঁজে পেয়ে রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন। দরিয়ুসের গ্রন্থাগার ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আলেকজান্দার_ সেই গ্রন্থাগারে বহু সহস্র চর্মপত্র রক্ষিত ছিল। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাও ছিল। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাও ছিল। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আলেকজান্দার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যাননি যা এই পার্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণস্বরূপে তুলনীয় হতে পারে।’
পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা এশিয়ার এই নবজাগরণকে যেমন বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তেমনি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি বা ভেদবুদ্ধি। এশিয়াকে জাগতে হলে এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতেই হবে, কেননা ‘সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি মানুষের যত অনিষ্ট করেছে এমন বিষয়বুদ্ধি করেনি। বিষয়াসক্তির মোহে মানুষ যত অন্যায়ী, যত নিষ্ঠুর হয়, ধর্মমতের আসক্তি থেকে মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়ভ্রষ্ট, অন্ধ ও হিংস্র হয়ে ওঠে। ইতিহাসে তার ধারাবাহিক প্রমাণ আছে।’
এ ক্ষেত্রেই শুভ দৃষ্টান্ত হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার কথা মনে এলো তাঁর : ‘নবযুগের আহ্বানে পশ্চিম এশিয়া কী রকম সাড়া দিচ্ছে সেটা স্পষ্ট করে জানা ভালো। খুব বড় করে সেটা জানবার এখনও সময় হয়নি। … কিন্তু সত্য ছোটো হয়েই আসে। সেই সত্য এশিয়ার সেই দুর্বলতাকে আঘাত করতে শুরু করেছে যেখানে অন্ধসংস্কারে, জড় প্রথায়, তার চলাচলের পথ বন্ধ। এ পথ এখনও খোলসা হয়নি, কিন্তু দেখা যায় এই দিকে তার মনটা বিচলিত।’ কী সেই সত্য? ‘এশিয়ার নানা দেশেই এমন কথা উঠেছে যে, সাম্প্রদায়িক ধর্ম মানবের সকল ক্ষেত্রজুড়ে থাকলে চলবে না।’ অর্থাৎ ধর্মাচরণ থাকবে কেবল কিছু নির্দিষ্ট এলাকায়_ সর্বত্র নয়; এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য মানলে, রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তো নয়ই। রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অবিমিশ্রভাবে সেক্যুলারিজমের সমর্থক।
৫. সভ্যতার সংলাপ
‘পারস্য-যাত্রী’ গ্রন্থটি খুঁটিয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের সমাজে নবজাগরণের সংকেতের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের সাথে ‘সংলাপ’-এর তাগিদ অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করেছেন। আবার ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে মুক্তি খুঁজেছেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বাইরে। সেখানে তিনি ব্যক্তিগত ধর্মীয় মূল্যবোধকে (যা ছিল ‘মিশ্র’ চরিত্রের) সাহসের সাথে লালন ও ক্রমবিকশিত করেছেন। খ্রীস্টিয় ইউরোপ এনলাইটেনমেন্ট-এর পর্ব পেরিয়েও যেমন যুক্ত হতে পারেনি বিশ্ব মানবতাবাদে, ধর্মাশ্রিত প্রাচ্যও তেমনি উপনীত হতে পারেনি মানবকল্যাণমুখী, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের উদার জমিনে। এদিকটি রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। ‘পারস্য-যাত্রী’ রচনার কালে যেমন, আজকের দিনেও ‘কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্ম ধর্মের বিশুদ্ধ প্রাণতত্ত্ব নিয়ে টিকে নেই’ _ কি পাশ্চাত্যে, কি প্রাচ্যে। আমরা ভুলে যাই, ‘যে সমস্ত ইটকাঠ নিয়ে সেই সব সম্প্রদায়কে কালে কালে ঠেকো দিয়ে দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য কালের আচার বিচার প্রথা বিশ্বাস জনশ্রুতি।’ আজকের দিনে হলে এ কথা লেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার মামলা উঠত। কটূক্তির কারণে তাঁর শিলাইদহের-সাজাদপুরের-পতিসরের বাড়িতে আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারত একদল ধর্মোন্মাদের দ্বারা। অন্যত্র পড়ি, ‘আরব পারস্যকে ধর্ম দিয়েছে’, বিনিময়ে পারস্য তার শিল্পগুণ দিয়ে ইসলামকে আরো ‘ঐশ্বর্যশালী’ করেছে। এক জায়গায় এ মন্তব্যও করেছেন, ‘মাদুরার মন্দির, ইস্পাহানের মসজিদ এসব প্রাচীনকালের অস্তিত্বের দলিল _ এখনকার কালকে, যদি সে দখল করে তবে তাকে জবরদখল বলব।’ এ কথা বলার জন্য এ যুগে তাঁর বিচার দাবি করতেন নিশ্চয় কেউ কেউ। কেননা ঊনিশ-বিশ শতকের গোড়ার দিককার অসহিষ্ণুতার চেয়ে একবিংশ শতকের সূচনা-পর্বে এসে ধর্ম_ প্রসঙ্গে অসহিষ্ণুতার মাত্রা দক্ষিণ এশিয়ায় আরো বেড়ে গিয়েছে। সমাজতাত্তি্বক আশিস নন্দী একথা আক্ষেপ করে বলেছিলেন। হাফেজের সমাধিতে গিয়ে যে-রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁকে এ রকম তিরস্কারের গ্গ্নানি এর আগেও অবশ্য অনেকবার সইতে হয়েছে। হাফেজকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, মনে মনে, ‘আমরা দু’জনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি… নিশ্চিত মনে হলো, আজ কত শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ পারস্য থেকে ফিরে গিয়ে ১৯৩৩ সালে স্পষ্ট করে বলেছেন মনের কথাটা : ‘আমার স্বভাবে এবং ব্যবহারে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নেই’, দুই পক্ষেরই অত্যাচারে ‘আমি সমান লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হই’। অথচ পরস্পরকে বাদ দিয়ে এদের এক পা চলারও উপায় নেই। পারস্য-যাত্রীতে কথাটা উপমা দিয়ে বলেছেন : ‘এই দুই বিপরীতধর্মী সম্প্রদায়কে নিয়ে আমাদের দেশ। এ যেন দুই যমজ ভাই পিঠে পিঠে জোড়া; একজনের পা ফেলা আর-একজনের পা ফেলাকে প্রতিবাদ করতেই আছে। দুইজনকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করাও যায় না, সম্পূর্ণ এক করাও অসাধ্য।’ এক্ষেত্রে মিল আসবে তখনই যখন ‘বিভিন্নতাকে’ শক্তি বলে জানব। বিভিন্নের মধ্যেকার সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিধি নিষেধের বেড়াগুলো ভেঙে যাবে। যতদিন তা না হয়; ততদিন বিভিন্নের মধ্যে ‘সংলাপ’ চলুক – সংঘাতকেই বড় করে দেখা না যেন হয়। এ-ই ছিল রবীন্দ্রনাথের দাবি আমাদের কাছে।
১৯৭৯ সালের ‘ইসলামি বিপ্লবে’র পর খোমেনী-উত্তর ইরানে অনেক নাটকীয়ও বিতর্কিত পরিবর্তন এসেছে গত তিন দশকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতি পারস্যের অনুরাগ যেন এখনো অটুট। ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকীতে ইরানের পার্লামেন্টে (মজলিস) উন্মোচন করা হয়েছে তাঁর স্মরণে একটি প্রস্তরফলক। তাতে উৎকীর্ণ তাঁর ‘পারস্যে জন্মদিনে’ কবিতাটি এবং তাঁর একটি চমকপ্রদ প্রতিকৃতি। প্রায় একই সময়ে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে। রক্ষণশীলতার কোনো কুযুক্তি এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রেজা শাহ্র ইরানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এ তথ্য জানার পরও ‘বিপ্লবী’ ইরানের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাদর একটুকু কমেনি। এক্ষেত্রে ইরানের ইসলাম তার অন্তরের শক্তিরই প্রমাণ দিয়েছে! এক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নী পারস্য-আরব এ ধরণের বিভাজন রেখা টেনে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা হবে পণ্ডশ্রম। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নানা সভ্যতার মধ্যে ‘সংঘাত’ যেমন, ‘সংলাপ’ও চলছে একই সাথে।
পারস্যে রবীন্দ্রনাথকে সম্মাননা দেওয়ার সময় বসরার গভর্নর শেখ সাদির একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন। কবিতাটির অংশবিশেষ রবীন্দ্রনাথের হাতে অনূদিত হয়ে ‘পারস্য-যাত্রীর’ পরিশিষ্টে সংকলিত হয়েছে। চতুষ্পদীটি এ রকম :
‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে!’
Original post on Samakal here.