সমকাল প্রতিবেদক
শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে। এটি গর্বের বিষয় হলেও আত্মতুষ্টির কিছু নেই। কেননা দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। মূলত সম্পদের অসম বণ্টন ও অবৈধ আয়ের উৎসের কারণে আয় বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন তারা। ‘দারিদ্র্য বিমোচন : কোথায় আমাদের অবস্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খোন্দকার। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু কাওসার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিই আমাদের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে পারলে জনগণ উন্নয়নের সুফল আরও বেশি পেত। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রাণবন্ত আলোচনায় দারিদ্র্যের কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। কারণ আয় বৈষম্য থেকে দারিদ্র্যের উৎপত্তি। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ার পেছনে কারণগুলো তুলে ধরেন বক্তারা।
তারা বলেন, প্রভাবশালীরা জমি দখল, জলাশয় দখল করে সম্পদ তৈরি করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। এসব অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীদের সম্পদ আরও বাড়ছে। অথচ গরিবের কাজের সুযোগ নেই, শিক্ষা নেই, ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, ব্যাংক থেকে ঋণের সুযোগও তাদের নেই। ফলে দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে না। দারিদ্র্য দূর করতে উৎপাদনমুখী কাজে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খোন্দকার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, গুলশান ক্লাবে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। যারা জুয়া খেলার পেছনে কোটি টাকা খরচ করে বুঝতে হবে তারা কত বড়লোক। তিনি বলেন, দারিদ্র্য মাপার বিষয় নয়, এটি অনুধাবনের বিষয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা অনুধাবন করা গেলে সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মন্ত্রী বলেন, ২০০৫ সালের তুলনায় দারিদ্র্য আরও কমেছে। শিগগির এ ঘোষণা দেওয়া হবে।
ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব এখনও প্রকাশ করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়াতে পারে ৩২ শতাংশ। যদি তাই হয় তাহলে দুই বছরে কমবে ৮ শতাংশ, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। আমাদের এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে।
অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র্য কমেছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত ৫ কোটি লোক দরিদ্র। কাজেই আমাদের আত্মতুষ্টির কারণ নেই। দারিদ্র্য কমাতে হলে গরিবদের উৎপাদনমুখী কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি। ড.ফরাস উদ্দিন মনে করেন, দারিদ্র্যের মূল কারণ কাজের সুযোগের অভাব। যারা গরিব তাদের সম্পদও নেই, নেই কাজের সুযোগও। দারিদ্র্যকে বহুমাত্রিক অভিশাপ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। দারিদ্র্য কমাতে শিক্ষা বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ভোকেশনাল শিক্ষা ফ্রি করার প্রস্তাব করেন তিনি।
ড. সেলিম রায়হান দারিদ্র্য হ্রাসের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০০০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। ২০০৫ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ। এলডিসিভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ অগ্রগতি অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।